আইসিইউয়ের সামনের ওয়েটিং লাউঞ্জের সোফায় বিরস বদনে বসে আছে নাজিয়া। তার মন খুবই খারাপ। এত অসহায় লাগছে,কিন্তু কিছুই করার নাই। তার হাত পা বাঁধা। নাজিয়ার হবু শাশুড়ি গত সাতদিন ধরে আইসিইউতে আছেন। এই সাতদিন ধরেই নাজিয়া হসপিটাল ডিউটি করছে। সারাদিন না অবশ্য। আধবেলা। বাকি আধবেলা ওর হবু শাশুড়ির একজন দূর সম্পর্কের বোন থাকেন।
নাজিয়া একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্রাইমারি সেকশনে পড়ায়। স্কুল শেষ করে সরাসরি চলে আসে হসপিটালে। তখন সেই ভদ্রমহিলা বাসায় চলে যান।
হসপিটালে কিছু করারও নেই। শুধু বসে থাকা। আইসিইউ থেকে কোন কারণে ডাকলে এটেন্ড করা। বাকি সময়টা সোফার উপর শুয়ে বসে, ফেসবুক ঘেঁটে পার করতে হয়।
নাজিয়ার মাঝে মাঝে হাউ মাউ করে কাদতে ইচ্ছা করে। কারণ সে পড়েছে উভয় সঙ্কটে। ওর বাড়ির কেউ বিয়ের আগে এই হসপিটাল ডিউটি করাটা পছন্দ করছে না।
একটু আগেও ওর মা ফোন দিয়ে বলেছেন— নাজিয়া ,তুমি এইসব কি শুরু করলা ? তোমার কি ওই ছেলের সাথে বিয়ে হইসে? তুমি কেন হসপিটালের ডিউটি করবা ? আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা শুনলে কি মনে করবে ?
নাজিয়া বলেছে – তাহলে কি করব মা ? না করে দিব ? বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে বলছো ?
নাজিয়ার মা তখন আমতা আমতা করে ফোন রেখে দিয়েছেন।
বিয়েটা ভেঙ্গে যাক এটা কেউ চাচ্ছে না। বরং বিয়েটা পিছিয়ে যাচ্ছে বলেই ওর বাবা মা ভীষণ নাখোশ ওর হবু স্বামীর উপর। উনারা কনফিউজড যে বিয়েটা আদৌ হবে কী না। নাজিয়া নিজেও কনফিউজড। তারও আজকাল মনে হয় বিয়েটা হবেই না।
আর এই সাতদিন টানা তার হবু হাজবেন্ডকে কাছ থেকে দেখে ওর টেনশন আরো বেড়ে গেছে।
লোকটা মোটের উপর ভালোই, কিন্তু খুব রগচটা টাইপের মনে হয়। ম্যানার ট্যানারের ধার ধারে না খুব একটা।
যেমন এঙ্গেজমেন্টের দিন যখন নাজিয়ার বড় খালু ওর হবু হাজবেন্ডকে বললেন —আপনারা দুইজনই ম্যাচিউর মানুষ। আলহামদুলিল্লাহ, দুজনই ঝাড়া হাত পা। আর বিয়েটাও যেহেতু খুব ঘরোয়াভাবে হবে, তাহলে আল্লাহর নাম নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব কাজি ডেকে কবুল বলে ফেলাই ভালো। ঐযে কথায় আছে না শুভস্য শীঘ্রম ? কি বলেন জামাই বাবাজি ?
সে ফট করে খালুজানের মুখের উপর বলে দিল— জ্বি না , বিয়ের ডেট দুইমাস পরে ঠিক করব। আমার ছেলের ফাইনাল পরীক্ষার পরে। এখন বিয়ে হবে না।
উল্লেখ্য, নাজিয়া এবং এই ভদ্রলোক দুইজনেরই এটা দ্বিতীয় বিবাহ। দুইজনেই ডিভোর্সি। দুইজনেরই একটা করে সন্তান আছে। নাজিয়ার একটি সাত বছরের কন্যা আর ভদ্রলোকেরটি দশ বছরের পুত্র। তখন ভদ্রলোকের পুত্রের পরীক্ষার কারণে ডেট ঠিক হল না আর পরীক্ষা শেষ হবার পরপরই তার মা অসুস্থ হয়ে হসপিটালে। উনার অবস্থা খুব বেশি খারাপ। সহসাই সুস্থ হবার কোন লক্ষণ এবং সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
অতএব খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে ওর হবু শাশুড়ি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের ডেট ঠিক হবার কোন সুযোগ নাই।
নাজিয়ার আর ভালো লাগে না এই একাকীত্ব, এই অনিশ্চিত জীবন!
গত পাঁচ বছর ধরে সে এই একাকীত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে টায়ার্ড হয়ে গেছে। আর যতদিন একা ছিল না ততদিন ও এত কষ্টে গেছে যে ওটা মনে হলে এখনও ভয় লাগে।
ওর প্রথম হাজবেন্ড ড্রাগ এডিক্ট ছিল। নেশা করে এসে সে নাজিয়ার গায়ে হাত তুলতো, ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করত। একদিন নেশার কারণেই তার চাকরিটাও চলে গেল। তারপর সব সেভিংস উড়িয়ে নাজিয়ার অর্নামেন্টস বেঁচে দিয়ে একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেল রাতারাতি। যখন আর কোনভাবেই কন্ট্রোল করা যাচ্ছিল না তখন ওর ভাসুর দেবররা মিলে রিহ্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু পর পর দুইবার ট্রিটমেন্টের পরেও যখন পরিবর্তন হল না , তখন নাজিয়া তার দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে।
নাজিয়ার বাবা মা আর ফিরতে দেননি ওকে।
এই পাঁচ বছরে অসংখ্য সম্মন্ধ এসেছে এবং সবই খুব অদ্ভুত অদ্ভুত। ওইসব বায়োডাটা দেখে নাজিয়ার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যেত। মানুষ ডিভোর্সি মেয়েদেরকে কি মনে করে আল্লাহই জানেন। এদের জন্য কোথা থেকে যেন বেছে বেছে সব ঘাটের মড়া টাইপ পাত্র খুঁজে আনে।
আর এমনিতেও প্রথম দিকে আবার বিয়ের করার ব্যাপারে ওর কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু হল তো অনেক। একা থাকারও তো একটা লিমিট আছে।
নাজিয়া আর একা থাকতে চায় না। আগেরবার তো সংসার কি তাই বোঝেনি। এইবার সে ঠিক করেছে খুব গুছিয়ে সংসার করবে। আর সমস্ত দিক বিবেচনা করে এই লোকটাকে ওর ভালোই লেগেছিল। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো জব করে। ওর থেকে বছর দশেক এর বড় যদিও তাতে কি ? নাক মুখ হাত পা সব যায়গা মত আছে এই ঢের।
আর ভদ্রলোকের বাচ্চাটাও লক্ষ্মী আছে। ওকে প্রথম পরিচয় থেকেই মা ডাকে। নাজিয়ার হবু শাশুড়িই শিখিয়ে দিয়েছিলেন মা ডাকতে।
ও যতদূর শুনেছে ভদ্রলোকের বউ পরকীয়া করে চলে গেছে অন্য আরেকজনের সাথে। নাজিয়া সত্য মিথ্যা জানে না। আর জানার চেষ্টা করাও বৃথা। ডিভোর্স হবার পরে সবাই আরেকজনের দোষের কথাই বলে। নিজের দোষ বলার মত, নিজেকে শোধরাবার মত সৎসাহস আর সদিচ্ছা কয়টা মানুষেরই বা থাকে ?
এইসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে নাজিয়ার চোখটা একটু লেগে এসেছিল বোধহয়।
এমন সময় পুরুষ কণ্ঠের ডাকে সে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। ওর হবু হাজবেন্ড এসেছেন অফিস শেষ করে।
নাজিয়া অপ্রস্তুত হাসি দিল তার দিকে তাকিয়ে।
ভদ্রলোক ওর হাসির তোয়াক্কা না করে মুখের উপর বলে বসলেন—হসপিটালে এসে ঘুমিয়ে থাকলে হসপিটাল এ আসার কি দরকার ? আইসিইউ থেকে ফোন দিয়ে পায় নাই কাউকে। প্রয়োজনের সময় যদি লোক না থাকে তাহলে অযথা লোক বসিয়ে রেখে আমার লাভ কি ?
নাজিয়া তড়িঘড়ি করে ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে দেখল দুইটা মিসড কল। ও লজ্জায় লাল হয়ে গেল
—কখনো এরকম হয় না। কাল রাতে ঘুম কম হয়েছিল একটু। তাই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সরি।
সেদিন রিক্সায় করে বাসায় ফেরার সময় খুব কেঁদেছিল নাজিয়া। একটা মানুষ এত কিভাবে রুড হতে পারে ? এখনও তো বিয়েও হয় নি। তার মাকে দেখার দায়িত্ব কেন নাজিয়া নেবে? কি অদ্ভুত! অথচ বিকেল পর্যন্ত ও কত কিছু ভেবে রেখেছিল। ভেবেছিল লোকটা আসলে হসপিটালের রুফটপ ক্যাফে তে কফি খেতে যাবে একসাথে।
সেরকম ভাবে সময় কাটানোর, চেনা-শোনার সুযোগও তো হয়নি এখন অব্দি। উনার ছেলের পরীক্ষা শেষ হবার পর পর একদিন বাইরে গিয়েছিল একসাথে। সেদিনের এক্সপেরিয়েন্সও খারাপই ছিল। সেদিন দেখা হবার সাথে সাথে বলেছিল—
এত কড়া রংয়ের লিপস্টিক আমি পছন্দ করি না। আর তোমার বয়সের সাথেও যায় না।এরপর থেকে হালকা কালারের লিপস্টিক দিও।
ভদ্রলোক শুরু থেকেই ওকে তুমি সম্বোধন করেন। এটাও ওর ভালো লাগে নাই। একটা মানুষের স্বাভাবিক ভদ্রতাবোধ থাকবে না ?
তবে আজকে উনি এক্সট্রিম করে ফেললেন। এরমধ্যে বাসায় যেতে যেতে রাস্তাতেই নাজিয়ার কন্যা তিন বার ফোন দিয়ে, মা আসো নে কেন আসো না কেন করেছে। এরপর, বাসায় পৌঁছানোর পর শুরু হবে মায়ের ভাঙ্গা রেকর্ড। বিয়ের ডেটের খবর নাই আমি কেন এত আদিখ্যেতা করছি তাই নিয়ে বাক্যবাণ।
মাঝে মাঝে নাজিয়ার ইচ্ছা করে ওর মায়ের মুখের উপর বলে দেয়—পাঁচ বছর ধরে আমার সব বিষয়ে আমার সব বিষয়ে তোমার ইনটারফেয়ারেন্স আমি আর নিতে পারছিনা না মা। তাই আদিখ্যতা দেখিয়ে হলেও বিয়ে করে এবার তোমার লেকচার থেকে মুক্তি চাই।
যাই হোক, এত সব জটিলতার মাঝে দিন তিনেক পরে নাজিয়ার জন্য একটু সুসময় ফিরে এলো।
কারণ ওর শাশুড়ির অবস্থা ভালোর দিকে। উনাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। হসপিটাল ডিউটির দিন শেষ হয়ে এল ভেবে নাজিয়া একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
ওর হবু শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ। তার পুত্রের মত বদ স্বভাবের নয়। খুব মিষ্টভাষী। নাজিয়াকে ভীষণ স্নেহও করেন।
এখন হসপিটালে আসতে নাজিয়ার অতটা খারাপ লাগে না।উলটা ভদ্রমহিলার সাথে একটা সখ্য গড়ে উঠছে ভেবে ভালোই লাগে। উনার রিলিজ হবার সময়ও চলে এসেছে। কাল পরশু বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে বলেছেন ডাক্তার।
সেদিনের মত শাশুড়ির কাছে বিদায় নিয়ে বাইরে এলো নাজিয়া। তার হবু বর ও সেদিন একটু আগেই চলে এসেছে অফিস থেকে। লাউঞ্জেই তাকে পাওয়া গেল।
নাজিয়া ভাবল তার সাথে এক কাপ কফি খেয়েই বাড়ি যাবে। আর তাছাড়া মা আজ জিজ্ঞেস করতে বলেছেন বিয়ের ডেট টা নিয়ে উনি কিছু ভেবেছেন কী না। এবার তো উনার মাও সুস্থ হয়েছেন।
কফি শপে বসে নাজিয়াই প্রথম নিরবতা ভাঙল।
বলল – মা জিজ্ঞেস করছিলেন বিয়ের ডেটটা নিয়ে কিছু ভেবেছেন কী না আপনি।
লোকটা উত্তর দিলেন—আজব মেয়ে মানুষ তো তুমি। বিয়ে করার জন্য এত মরিয়া হয়ে গেছ কেন ? আমি কি মারা যাচ্ছি না পালিয়ে যাচ্ছি ?আমার মা কে সুস্থ হয়ে বাসায় যেতে দিবা তো নাকি তার আগেই বিয়ে করতে হবে ?
নাজিয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।
কিন্তু উনি থামলেন না
— আর হসপিটালে এত সেজে আসার কি দরকার ?তুমি তো আনম্যারেড কচি খুকী না। মনে থাকে না যে এটা তোমার দ্বিতীয় বিয়ে। তাই না?
নাজিয়া ভদ্রলোকের কথা শেষ হবার পর ঠিক দুই মিনিট তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
তারপর অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। লোকটাও অবাক হয়ে ওর পেছন পেছন হাঁটা দিল।
নাজিয়া প্রথমে তার ‘হতে পারত’ শাশুড়ির কেবিনে গিয়ে তার হাত দুটো ধরে বলল—আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি অসুস্থ না হলে এতদিনে আমার বিরাট বড় সর্বনাশ হয়ে যেত। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ফর সেভিং মাই লাইফ।
সহজ সরল সেই ভদ্রমহিলা কিছু না বুঝেই বললেন— বেঁচে থাক মা, বেঁচে থাক।
ততক্ষণে তার “হতে পারত” হাজবেন্ডও তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভদ্রলোকের হতভম্ব হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে নাজিয়া পরিস্কার উচ্চারণে বলল— আপনার মত ম্যানারলেস, আনকালচারড, আনসিভিলাইজড লোকের বউয়ের একটা না দশটা পরকীয়া করা উচিত। সিক কোথাকার।
তারপর গট গট করে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সায় উঠে পড়লো। রিক্সায় উঠার পর ওর মনে হল ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল। কি করতে যাচ্ছিল ও ? আগের বারের বিয়েটা এক্সিডেন্ট হলে এটা হতে যাচ্ছিলো সুইসাইড।
একা না থাকতে চাওয়ার মানে কি জেনে শুনে বিষপান ?
বিয়েটা ভেঙ্গে যাওয়ায় মন খারাপ হবার বদলে মন ভালো হয়ে গেল ওর। নিজেকে হঠাত খুব নির্ভার মনে হল।
বাসায় ফিরে মার সাথে দেখা হওয়া মাত্র মা নাজিয়া বলল
– বিয়েটা আমি ভেঙ্গে দিয়ে এসেছি মা।
নাজিয়ার মা আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
– বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে আসছ মানে কি ?
নাজিয়া অদ্ভুত শীতল কন্ঠে উত্তর দিল
– একবার তোমাদের পছন্দে বিয়ে করে দেখেছি মা। এবার আমি ভালবেসে আমার নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করব। আমার ডিভোর্স হয়েছে এর মানে এই না যে আমি মারা গেছি। আমি তখনই বিয়ে করব যখন আমার যোগ্য কাউকে খুঁজে পাব।
স্বামী নামক পুরুষের আমার দরকার নাই। এবার আমি একজন মানুষকে বিয়ে করব…..!
লেখক: গল্পকার/প্রাবন্ধিক