করোনাভাইরাসকে সাথে নিয়ে আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে বিশ্ববাসীকে। স্থায়ী প্রতিরোধী হওয়া যাকে আমরা হার্ড ইমিউনিটি বলছি সেটি এখনও অধরা পাখি। গবেষণাগুলো বিশ্বে কত লোক সংক্রমিত হল, সুস্থ হওয়ার পর স্থায়ীভাবে ইমিউনিটি কতজন পাচ্ছেন সে হিসেব কষেই যাচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হওয়া শহরগুলোতেও নিতান্তই মুষ্টিমেয় লোক হার্ড ইমিউনিটি পেয়েছেন।
হার্ড ইমিউনিটি কী?
হার্ড ইমিউনিটি মানে এ রোগের জন্য স্থায়ীভাবে প্রতিরোধী হওয়া। এর মানে হল ভাইরাসটি যদি শরীরে প্রবেশ করেও মানুষকে আর আক্রান্ত করতে পারবে না।
কীভাবে পাওয়া যাবে হার্ড ইমিউনিটি?
হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব ২ ভাবে একটি হল টিকা দ্বিতীয়টি হল আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়া।
সব সুস্থ হওয়া ব্যক্তিরা কী স্থায়ীভাবে প্রতিরোধী?
না। নতুন গবেষণাগুলো জানিয়েছে বেশি মানুষ আক্রান্ত হওয়া শহরে কেবল ০-১৪ শতাংশ লোক স্থায়ী প্রতিরোধী ক্ষমতা পেয়েছেন। বাকিরা এখনও পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন।
হার্ড ইমিউনিটি কীভাবে করোনাকে দূর করতে পারে?
প্রথমত বুঝতে হবে ভাইরাসটি পৃথিবী থেকে একেবারে বিদায় নেবে না। এটি থাকবে আরও অন্তত ২০ বছর। তবে ৬০-৮০ শতাংশ মানুষ যদি স্থায়ীভাবে প্রতিরোধী হন তাহলে ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে যাবে। সংক্রমণের সংখ্যা কমে যাবে। যারা সংক্রমিত হবেন তাদের সহজেই সারিয়ে তোলা যাবে —এমনটাই মনে করেন বেশিরভাগ মহামারি বিশেষজ্ঞরা।
তবে করোনাভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হওয়া বিশ্বের বেশ কয়েকটি শহরে সুস্থ হওয়া অনেক মানুষই পুনরায় ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। হাতে গোণা কজন মানুষই ছুঁতে পেরেছেন হার্ড ইমিউনিটিকে।
হার্ড ইমিউনিটি কীভাবে অর্জন সম্ভব?
বিশেষজ্ঞদের একটি দল বলছেন, সংক্রমণের গতি ধীর হলে কম মানুষ আক্রান্ত হবে। তারা চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হবেন। আবার কম সংখ্যক মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হবেন তারাও চিকিৎসায় সেরে উঠবেন পাবেন। সংক্রমণের সংখ্যা কমানো গেলে খুব ধীরে হলেও হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব হবে।
এই ধারণা থেকে কিছু দেশ হার্ড ইমিউনিটি বাড়াতে ‘সীমিত লকডাউন’ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এসব স্থানে কেবল ৭-১৭ শতাংশ লোক এখনও পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিউইয়র্ক সিটিতে যেখানে করোনাভাইরাস আক্রমণ করেছে সবচেয়ে বেশি সেখানেও কেবল ২০ শতাংশ লোক মে মাসের শুরুর দিকে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। করোনার কাছে হার মেনে মৃত্যুকে বরণ করার সংখ্যাও বেশি সেখানে।
২০ শতাংশ সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্য থেকে টেস্ট করে দেখা হচ্ছে স্থায়ীভাবে ইমিউন হলেন কারা।
হার্ড ইমিউনিটির এমন সমীক্ষা চলছে চীনেও। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রথম শুরু হওয়া শহর উহান এখনও তাদের ফলাফল জানায়নি। উহান শহরের একটি হাসপাতালের গবেষণায় দেখা গেছে, যারা লকডাউনের পর কাজে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ লোক ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মহামারি বিশেষজ্ঞ মিশেল মিনা বলেছেন, ‘ মিলিয়ে বলা যায় বিশ্বজুড়ে বেশিরভাগ স্টাডি বলছে— খুব শীঘ্রই হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে আমরা কোন সুসংবাদ পাচ্ছি না। এই নতুন ভাইরাসটির প্রতিরোধের দ্বার এখনও অনিশ্চিত।
তবে কিছু মহামারি বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, ৬০-৮০ শতাংশ লোকেরা সংক্রমিত হয়ে সুস্থ হলে এ প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। রাষ্ট্রের জনসংখ্যার নিম্নস্তর থেকে যদি হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠে তাহলেই সুফল পাওয়া যাবে।
মিশেল মিনা বলেন, ‘নিরাপদভাবে হার্ড ইমিউনিটি পেতে আমাদের অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হবে। পরীক্ষাগুলো চলছে তব সেগুলো পুনরায় যাচাই করা হচ্ছে না। করোনা নিয়ে ওই স্টাডিগুলো খুব নিখুঁতও নয়। ‘
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক কার্ল বার্গস্ট্রোম বলেছেন, ‘সামষ্টিকভাবে প্রায় সবগুলো দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে এর আরও বিস্তার পাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। মানুষের ঘনত্ব এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার উপর নির্ভর করবে হার্ড ইমিউনিটি পাওয়ার বিষয়টি।
তার মতে মোট জনসংখ্যার নিদেনপেক্ষে ৬০ শতাংশ মানুষের হার্ড ইমিউনিটি থাকতে হবে। তিনি বলেন,এটি ভ্রান্ত বিশ্বাস যে একবার সংক্রমণ মানুষকে দ্বিতীয়বার অসুস্থ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্থায়ী ক্ষমতা অর্জন করবে এমন লোক খুব মুষ্টিমেয়।’
হার্ড ইমিউনিটি ইতিবাচক কীভাবে
হার্ভার্ডের ডা. মিশেল মিনা এই রোগের বিস্তারকে ধীর করা গেলে হার্ড ইমিউনিটি সম্পর্কে ইতিবাচকভাবে ভাবা যাবে বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, ‘ধরুন আপনি সংক্রমিত হলেন। তারপর এমন একটি কক্ষে গেলেন যেখানে তিনজন ব্যক্তি আছে। যত জায়গায় আপনি যাবেন গড়ে ৩ জন করে ব্যক্তিকে সংক্রমিত করবেন। কেউ আছেন ‘সুপার স্প্রেডার’ তারা নতুন করে দিনে ১০০ জনকে সংক্রমিত করতে পারে। তবে আপনি যদি এমন ৪ জনের কাছে যান যারা ইতিমধ্যে প্রতিরোধক ক্ষমতা অর্জন করেছেন; সেখানে গড়ে একজনকে আক্রান্ত করতে সক্ষম হবেন। বাকি তিনজন নিরাপদে থাকবেন।’
হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডেমিওলজির অধ্যাপক জিপসিয়ামবান ডিসুজা বলেছেন, ‘যদি ধরে নেন যে ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী। তার মানেও কিন্তু মোট জনসংখ্যার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। নিউইয়র্কে দেখুন প্রতি ১০ হাজার নগরবাসীর মধ্যে প্রায় ২৫০ জন গড়ে মারা গেছে। নিউইয়র্ক সিটিতে এখনও লাখ লাখ বাসিন্দা এ রোগে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং আরও কয়েক হাজার হাজার লোক মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘অধ্যাপক ডিসুজা বলেন, করোনা যেখানে গিয়েছে সেখানেই তার নতুন পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। নিউ ইয়র্ক সিটিতে, যেখানে অ্যান্টিবডি টেস্টিং অনুযায়ী সবশেষ ২২ শে মে নাগাদ ২০ শতাংশ লোক ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল এবং যেখানে ১৮ হাজারেরও এরও বেশি লোক মারা গিয়েছে। এই বড় সংখ্যার মৃত্যুটি সংক্রমণের মোট মৃত্যু হারে দেখলে সেটি কেবল ১ শতাংশ। অথচ ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যুর হার ছিল ০.১- ০.২ শতাংশ। কোভিড -১৯ ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক। রোগ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু ঝুঁকিটাই সবচেয়ে ভয়াবহ।
প্রথম থেকেই কেউ কি এই ইমিউনিটি পেয়েছেন?
ডিসুজা বলেন, ‘প্রথমে আপনাকে জানতে হবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভাইরাসটি একেবারেই নতুন। পৃথিবীর কারও কাছে কোনদিন করোনাভাইরাসের কোনরকম প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল না। এবং এর অর্থ এই যে—সংক্রমণের মৃত্যুর হার যদি একই রকম থাকে তবে ভাইরাসটি আরও অনেক লোককে হত্যা করার সম্ভাবনা রয়েছে। ভাবতে হবে বড় জনসংখ্যার এক শতাংশ মানে ছোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের চেয়ে বড়।’
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক অ্যান্ড্রু নয়েমার বলেছেন, ‘৩২৮ মিলিয়ন আমেরিকানদের মধ্যে বেশিরভাগই ফ্লু মৌসুমের শুরুতে ফ্লুতে আক্রান্ত হন। অথচ কোভিড-১৯ ফ্লুর থেকে বেশি ভয়ানক।
নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে
সূত্র- https://www.nytimes.com/interactive/2020/05/28/upshot/coronavirus-herd-immunity.html?action=click&module=Top%20Stories&pgtype=Homepage