পাড়া প্রতিবেশিরা শেফালী বানুকে দেখলেই আফসোস করে। আর কেমন এক ‘আহারে’, ‘উহুরে’ করে ইশারা ইঙ্গিতে বলে, জোয়ান বয়সে বিধবা না হইয়াও বিধবার জীবন। জামাই থাকতেও জামাইয়ের সুখ নাই মাইয়াডার কপালে! কেউ কেউ সত্যিই কষ্ট পায় সেটা শেফালী বোঝে। পাড়ার কেউ কেউ বলেও বসে —‘বউ তোমার আর এমন কি বয়স! এই জামাইরে ছাইড়া দেও, নতুন করে জীবন শুরু করো। এই খোজা জামাইয়ের লগে থাইক্কা কি হইবো? তোমার তো একটা মাত্র মাইয়া। পোলা না থাকলে ভবিষ্যতে কে দেখবো তোমারে?’
শেফালী বানু কারো কোন কথার উত্তর করে না, চুপচাপ থাকে।
আর মনে মনে বলে, আমার শরীরের এত জ্বালা নাই, জ্বালা ছিলো মনে, সারাক্ষণ মনের জ্বালায় মরতাম। কিছু করনের ছিলো না আমার। মানুষ হইয়াও কুত্তা, বিলাইয়ের জীবন ছিলো আমার। এখন আমি যে কত শান্তিতে আছি, তা শুধু আমিই জানি। আর শরীরের জ্বালা, কয়টা মাইয়া মানুষ নিজের ইচ্ছায় মিটাইতে পারে? সেখানেও তো পুরুষ মানুষের ইচ্ছার দাসী তারা, হেগো ইচ্ছমতো হেরা হেগো বউরে ভোগ করবো, বউয়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কি দাম? শেফালী আরও ভাবে—আমারে তো পাড়া-প্রতিবেশী সবাই সুন্দরই কয়, তারপরেও কেন গেছিলো পূর্ব পাড়ার রমিজের বউয়ের ঘরে রাইতে?
রমিজ কামলা মানুষ, ধানের মৌসুমে যখন কামলা দিতে গেছিলো, হাওড় অঞ্চলে সেই সময় রমিজের বউ আলেমা ছিলো একলা বাড়িতে।
তখন আলেমা একদিন আম্মারে বাসায় আইসা কইয়া গেছিল—‘কাকি। আফনের পোলায় কিন্তু রাইতে আমার ঘরের চালে ঢিল দেয়।জানালায় ধাক্কা দেয় । আপনে এর বিচার করবেন। ’
এই কথা শুনে আমার শাশুড়ি উল্টা আলেমারে গালি দিয়া কয়েছিল —‘বান্দি মাগী, কামলার বউ হইয়া আমার পোলার নামে বদনাম দিতে আইছস কোন সাহসে? নিজে জামাই কামলা দিতে গেলে বেটা মানুষ দেখলে রং-ঢং করস, তা না হইলে বেটারা তোমার বাইত্তে ঢিল দেয় ক্যান? ’
তার তিনদিন পরের কথা। আলেমার ঘরে এক রাতে ঘটে সেই ঘটনা। শেফালী বানুর জামাই আলেমার ঘরে ঢুকে। আলেমারে যখন বল খাটিয়ে ধর্ষণ করতে যায়। আলেমা ঘরে থাকা নতুন বলাকা ব্লেডটা কাজে লাগায়। আলেমা শুধু কামলার বউ না, নিজেও পরিশ্রমী মানুষ, তার খেটে খাওয়া শরীরের জোর কোন বেটা ছেলের চাইতে কম আছিলো না।
তারপর শেফালী তার আধমরা জামাইরে নিয়া সদর হাসপাতালে ছিলো ১৫ দিন। হাসপাতালের সবাই তার জামাইরে দেখতে আসত। টিটকারি দিয়ে কথা বলে চলে যেত। শেফালী জামাইর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবত— যে মানুষটা ‘পুরুষ মানুষ’ হওয়ার কারণে তারে কুত্তা- বিলাইয়ের চাইতেও ছোট করে দেখত, সেই মানুষ শক্ত করে চোখ বন্ধ করে আছে। ইচ্ছে করে ঘুমের ভান করে আছে। ঠিক যেমন জোঁকের মাথায় নুন পড়লে জোঁক কুঁচকে যায়; তেমনি কুঁচকে যাচ্ছে তার ঘরের পুরুষটা। এটা দেখে সে দারুণ তৃপ্তি পেত শেফালী।
ওই ঘটনায় কোন পক্ষ আর মামলা করেনাই। কি নিয়া মামলা করব? অন্যের বউরে জোর করে ধর্ষণ করার জন্য তার দণ্ড কেটে দিয়েছে সামান্য এক কামলার বউ! তবুও মাতব্বর বাড়িতে ছোট একটা সালিশ বসেছিল। তখন আমার শাশুড়ি বলছিলো আলেমারে গ্রাম ছাড়া করার কথা।
তখন আলেমা ভরা মজলিসে জোর গলায় বলে বসে—পারলে আমার নামে দণ্ড কাটনের মামলা করতে বলেন। আমি গ্রাম থেকে যাবো কোন দুঃখে? আমিও মামলা করমু আমার ইজ্জত নিতে চাওয়ার। ভরা মজলিসের সবাই বুঝতে পারে আলেমার ওই চন্ডী রুপ। আলেমা নরম কোন মাটির পুতলা না যে ওরে ভাঙ্গা এত সহজ হবে! সেদিন আলেমার জামাই সিনা টান টান করে নিজের বউয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আর বলতে থাকে— ‘গরীব মানুষ বইলা কি আমার বউয়ের ইজ্জত নাই?’
সেদিন শেফালীর শাশুড়ি শেফালীর জামাইরে নিয়া বাড়িতে ফিরে আসে। কেউ আর থানা পুলিশ করতে চাইছিল না।
শেফালীর জামাই আগে শেফালীর গায়ে প্রায় প্রায় হাত তুলত, শেফালী কিছু বললেই বলত —‘জামাইয়ের ভাত খাইতে মজা লাগে, আর কিল খাইতে মজা লাগে না? তাইলে বাপের বাড়ি যাগা, আমি আবার বিয়া করমু।’ আর শেফালীর শাশুড়ি ছিল আরেক কাঠি সরেস, সে বলত —‘একটু চড় থাপ্পর মারলেই কানতে থাকো কেন? জানো না মাইয়া মানুষের জীবন বান্দির জীবন!’ শাশুড়ি ওই নারী শেফালীর কষ্ট তো বুঝতই না তার উপরে ছেলেকে আরো উসকায় দিত। সারাক্ষণ বলত—‘পোলা হইলো খাঁটি সোনা, সোনা বাঁকা হইলেও আশি টাকা তোলা।’
এখন শেফালীর শাশুড়ি আর বলে না— ‘আমার পোলারে ভালো না লাগলে বাপের বাড়ি চইলা যাও, বরং মা – পোলা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে, শেফালী যদি চলে যায়? তারা সেঁটিয়ে থাকে। ‘যদি সবাই আবার আঙুল দিয়া তাগো দেখাইয়া কয়— ‘খোঁজা জামাইয়ের ঘর কোন মাইয়া মানুষ ঘর করে নাকি? ’
যদিও শেফালী এ সংসার ছেড়ে চলে যাবার কথা কখনো ভাবে না।
যেদিন আলেমার ঘর থেকে গ্রামের মানুষ তার জামাইরে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছিল সেদিনই সে মনে মনে বলছে—‘আজ থেকে আমি আমি বিধবা।’