ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট কোনটা ভাল কোনটা খারাপ। আলো ও অন্ধকার পৃথিবীর দুই বিপরীত ঘটনা। কক্সবাজারে স্বামী ও সন্তানকে বেঁধে রেখে নারী পর্যটককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পর এমন কিছু কারণেই আশিকুল নামটি বাংলাদেশের নেটদুনিয়ায় ভাইরাল। সাতজনের নামে মামলা হলেও তিনজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই অভিযুক্তদের মধ্যে আশিকুল ইসলামের ফেসবুক আইডিতে ঢু মেরে দেখা গেল এ যেন একেবারেই অন্য মানুষ। যেন একই মুথখর দুটি চরিত্রের গল্প।
আশিকুল ইসলামের ফেসবুক আইডিতে গিয়ে দেখা যায়, চলতি বছরের ২৯ নভেম্বরের পরে কয়েক দিন কোনো স্ট্যাটাস ছিল না। এরপর তিনি আবার ফেসবুকে সক্রিয় হন ১৮ ডিসেম্বর। কারণটা এখন অবশ্য সবার জানা। কারণ ওই সময়ে আশিকুল ছিনতাই মামলায় জেলে ছিলেন।
আশিকুলের ফেসবুক চরিত্র অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, উপকারী ও আধ্যাত্মিক ধারণায় মহিমান্বিত এক অনন্য মুসলিম। জীবনকে সুন্দর রাখার নানা ধরনের ধর্মীয় উপদেশ বাণী আছে তার অনেকগুলো স্ট্যাটাসে।
গত ২৮ মে তিনি নিজের একটি ছবি দিয়ে সেখানে লিখেছেন,
‘জীবনটাকে সুন্দর করতে হলে, দুষ্টু লোকের ছায়া থেকেও দূরে থাকতে হবে।
আবার গত ১৭ এপ্রিল দেওয়া স্ট্যাটাসে আশিকুল ইসলাম লিখলেন,
‘বিদেশে যাইতে লাগে বিমান, আর জান্নাতে যাইতে লাগে পারফেক্ট ইমান।’
এরপরের বাণীসংবলিত স্ট্যাটাসটি ১৪ এপ্রিলের। গোল টুপি পরে শ্মশ্রুমণ্ডিত আশিকুল ইসলাম লিখেছেন,
‘জীবনটাকে রোজার মতো করে কাটাও, মৃত্যুটাও ঈদের মতো লাগবে।’
গত এপ্রিলে আশিকুল ইসলাম ফেসবুকে তিনটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। যেমন ১৪ এপ্রিল লিখলেন,
‘সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজেকে চেনা এবং সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে অন্যদেরকে উপদেশ দেয়া।’
৭ এপ্রিল আরেকটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে লিখলেন,
‘সুন্দর একটা পৃথিবী চাই, মুসলমান আমরা ভাই ভাই।’
গত ২০ জুন আশিকুল ইসলাম ফেসবুকে লিখেছিলেন,
‘অতীতের সবকিছু ভুলে, সৎ পথে থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে মহান আল্লাহর নামে শুরু করলাম, আমার জন্য দোয়া করবেন সবাই।’
২৭ জুন তিনি দোয়া চেয়ে আবার লিখলেন,
‘প্রত্যেক মানুষের একটা অতীত থাকে, আমারও একটা অতীত ছিল, আমি আর সেটা নিয়ে একটুও চিন্তা করতে চাই না, এখন শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই, সকলের সহযোগিতা এবং দোয়ার আর্জি প্রার্থনা করছি।’
গত ২১ নভেম্বর তিনি লিখেছিলেন,
‘হারাম থেকে বেঁচে থাকো, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবে!’
কে এই আশিকুল?
পুলিশ বলছে, প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম আশিকুল ইসলাম। তিনি কক্সবাজার পৌরসভার বাহারছড়া এলাকার একজন দাপুটে সন্ত্রাসী বলে জানা গেছে। তার বিরুদ্ধে ছিনতাই, নারী নির্যাতনসহ নানা অভিযোগে ১৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ছিনতাই মামলায় তিনি জেল খেটে বের হয়েছেন গত ৮ ডিসেম্বর। পুলিশ বলছে, এসব মামলায় বেশ কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছে আশিকুলকে। এর আগের মামলাগুলোর কয়েকটিতে অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে। সবশেষ দেড় মাস আগে জেল থেকে জামিনে বের হয়ে আসেন আশিক। এরপর আগের মতোই চাঁদাবাজি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
কীভাবে ঘটেছিল সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা?
ভুক্তভোগী নারীর ভাষ্যে, বুধবার (২২ ডিসেম্বর ২০২১) সকালে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে স্বামী-সন্তানসহ কক্সবাজার বেড়াতে আসেন। উঠেন শহরের হলিডে মোড়ের একটি হোটেলে। সেখান থেকে বিকেলে যান সৈকতের লাবনী পয়েন্টে। সেখানে অপরিচিত এক যুবকের সঙ্গে তার স্বামীর ধাক্কা লাগলে, কথা কাটাকাটি হয়। এর জেরে সন্ধ্যার পর পর্যটন গলফ মাঠের সামনে থেকে তার ৮ মাসের সন্তান ও স্বামীকে সিএনজি অটোরিকশায় করে কয়েকজন তুলে নিয়ে যায়। এ সময় আরেকটি সিএনজি অটোরিকশায় তাকে তুলে নেয় তিন যুবক। পর্যটন গলফ মাঠের পেছনে একটি ঝুপড়ি চায়ের দোকানের পেছনে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে ওই তিন যুবক।
তিনি আরও জানান, ধর্ষণ শেষে তাকে জিয়া গেস্ট ইন নামে একটি হোটেলে নেওয়া হয়। সেখানে ইয়াবা সেবনের পর আরেক দফা তাকে ধর্ষণ করেন ওই তিন যুবক। ঘটনা কাউকে জানালে সন্তান ও স্বামীকে হত্যা করা হবে জানিয়ে রুমের বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন তারা। এই হোটেল থেকে ওই নারীকে উদ্ধার করে র্যাব।
ভুক্তভোগী আরও জানান, জিয়া গেস্ট ইনের তৃতীয় তলার জানালা দিয়ে এক যুবকের সহায়তা কক্ষের দরজা খুলেন তিনি। তারপর ফোন দেন ৯৯৯-এ। পুলিশ তাকে থানায় সাধারণ ডায়েরি করার পরামর্শ দেয়। তারপর পাশের একজনের সহযোগিতায় কল দেন র্যাবের কাছে। তারা এসে তাকে উদ্ধার করে। তার স্বামী ও সন্তানকে উদ্ধার করা হয় পর্যটন গলফ মাঠের সামনে থেকে।
ভুক্তভোগীর স্বামী বলেন , ‘সামান্য ধাক্কাধাক্কির কারণে তারা আমার এত বড় ক্ষতি করল। অপরিচিত বলে শহরের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেলেও, সে জায়গা ও দুর্বৃত্তদের চিনতে পারিনি। বার বার হাতে-পায়ে ধরলেও তারা আমার স্ত্রীকে ফেরত দেয়নি। বেড়াতে এসেছিলাম বেতন পাওয়ার খুশিতে। এখন স্ত্রীর অবস্থা ভাল না। তাকে নিয়ে চিন্তায় আছি।’
গণধর্ষণের ঘটনায় ৭জনের নামে মামলা
এজাহারে চার জনের নাম উল্লেখ করে ৩জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মোট ৭জনের মামলা দায়ের হয়েছে বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর ২০২১) । বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার সদর থানায় ধর্ষণের শিকার ওই নারীর স্বামী বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান মামলা দায়েরের তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ভুক্তভোগী নারীর স্বামী চার জনকে আসামি করে অজ্ঞাতনামা আরও দুই-তিন জনের নামে মামলা দায়ের করেছেন। গুরুত্বের সঙ্গে আমরা মামলাটি তদন্তের ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ধর্ষণকাণ্ডে মামলার এজাহারে নাম উল্লেখ করা চার আসামি হলেন
আশিকুল ইসলাম আশিক
ইসরাফিল জয় প্রকাশ জয়া
মেহেদী হাসান বাবু ও
রিয়াজ উদ্দিন ছোটন
এরমধ্যে ছোটন জিয়া গেস্ট ইনের হোটেল ম্যানেজার।