আপনি যদি মনে করে থাকেন যে, অপরাধ শুধু সেই লম্বা দাঁড়িওয়ালা পুলিশ কর্মকর্তাটির তাহলে ভুল করবেন। সেই পুলিশ কর্মকর্তাটির অবলম্বে গ্রেফতার ও শাস্তি দাবি করছি। তাকে কেবল একজন অধ্যাপক বা একজন নারীকে অবমাননা করার জন্যে শাস্তি দিলে হবে না। আমি দেখতে চাই যে এই লোকের বিরুদ্ধে সেইসব বিধান প্রয়োগ করা হোক যেসব বিধানের কথা আমাদের সরকারের মন্ত্রী এমপি ও সরকারের দলের নেতারা হরদিন বলতে থাকেন- রাষ্ট্রদ্রোহিতা, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা ইত্যাদি। কেননা এই পুলিশ কর্মকর্তাটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক পোশাক গায়ে পরে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক নীতি ও মৌলিক অধিকারসমূহের অবমাননা করেছে।
এটা হল তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা তথা ঘটনা নিয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার কথা। কিন্তু এই ঘটনাটিকে তো কেবল একজন ব্যক্তির ঘটানো স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন অপরাধ মনে করলে ভুল করবেন। এ ঘটনাটি একটি রাজনৈতিক ঘটনাও বটে। এবং ঘটনাটি রাজনৈতিক ঘটনা বিধায় এর রাজনৈতিক দায়ও নিতে হবে। কাকে রাজনৈতিক দায় দিবেন? আপনি আমি আমরা যারা কোন না কোনোভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত আমাদের নিজেদেরও একটা দায় আছে। আমাদের দায়টা ব্যর্থতার দায়। দেশে সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতে ও মিসোজিনি (নারীবিদ্বেষ) ঠেকাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমি নিজে এই দায় মাথা পেতে নিই, ব্যর্থতার গ্লানি মেনে নিই। প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছি।
আমরা তো প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছি। যারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যে একজন পুলিশ কর্মকর্তা পুরো ইউনিফর্ম পরে প্রকাশ্য রাজপথে দিনের বেলায় একজন নারীকে উচ্চারণের অযোগ্য ভাষায় হেনস্তা করবে ওদের দায় তো আরও বেশি। এই পুলিশ কর্মকর্তা একজন অধ্যাপককে টিপের জন্য কেন হেনস্তা করলেন? অধ্যাপক কপালে টিপ পরেছেন বলে। টিপ পরা কি অপরাধ? না। টিপ পরা কি অশ্লীলতা? না। তাইলে এই দাঁড়িওয়ালা পুলিশ সাহেব কেন নারীর কপালে টিপ দেখে ক্ষেপে গেলেন?
১. নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি
ছ সাত বছর আগের কথা। জেনিফা, আমার ছোট বোন, আমার একজন ভাবী, আমার দুই মেয়ে আর আমার বন্ধুর কন্যা ওরা সকলেই সেবার পুঁজোর সাজে সেজেছে। শাড়ি, গয়না এসব পরেছে, সাথে কপালে টিপ সিঁদুর এইসবও। এইরকম সাজগোজ করেছে সবাই, অনেক ছবি টবি তুলেছি। কয়েকটা ছবি ফেসবুকে পোস্টও করেছি আমরা সবাই। সেইসব ছবিতে দেখা গেল লোকে নানারকম সাম্প্রদায়িক ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য করছে। যারা মন্তব্য করেছেন তারা এমনি এলেবেলে লোক না, যাদেরকে আপনার সভ্য ভদ্র সুশীল মানুষ মনে হয়ে সেরকম লোকজন। আমাদের দিক থেকে আমরা ওদেরকে বিনয়ের মনে করিয়ে দিয়েছি যে ভাই, কে কি পোশাক পরবে কিভাবে সাজগোজ করবে সে তো যার যার ইচ্ছা।
আমার স্ত্রী কন্যা বোন ভাবী ও বন্ধুর কন্যা ওদের অভিজ্ঞতা তো অতোটা তীব্র কিছু ছিল না। কিন্তু টিপ পরা ছবি পোস্ট করার জন্যে ফেসবুকে ভয়ানক সব গালাগালি শুনতে হয়েছে বা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে এরকম অভিজ্ঞতা অনেক নারীরই রয়েছে। আর সাধারণত টিপ পরে বলে আমাদের দেশের অনেক খ্যাতিমান বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও উন্নয়নকর্মী নারী নেত্রীবৃন্দকে তো আমরা ক্রমাগত গালাগালি করতে দেখি একদল লোককে। শাখা সিঁদুর টিপ এইসবের জন্যে নারীকে কর্মক্ষেত্রেও নানা সময় হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে সেকথাও আমরা জানি। এই দাঁড়িওয়ালা পুলিশ কর্মকর্তাটি একজন অধ্যাপকের সাথে যে আচরণ করেছেন সেটা সেই অর্থে খুব অভিনব নয়।
অন্যসব কথা বাদ দিলেও, একজন নারীর পোশাক ও তার সাজগোজ নিয়ে এইরকম হয়রানিমূলক আচরণ কেন করে এইসব লোকেরা? এইটার পেছনের কারণগুলিকে আপনি দুইটা ভাগে ভাগ করতে পারেন সাম্প্রদায়িক কারণ আর পুরুষতান্ত্রিক কারণ। আমরা যেটাকে ইন্টারসেকশনালিটিবলি, এইটা হচ্ছে সেইরকম একটা উদাহরণ। দাঁড়িওয়ালা পুলিশ অফিসারটির আচরণ যদি দেখেন, এই লোকটির আচরণ একইসাথে নারীর প্রতি তার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দুইটারই প্রতিফলন মিসোজিনি (নারীবিদ্বেষী) ও সাম্প্রদায়িকতা।
২.রাষ্ট্র সরকার ও রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীদের দায় কি?
রাষ্ট্র ও সরকারের কথা আগে বলে নিই। রাষ্ট্র হিসাবে যে চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠার জন্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা আপনি দেখতে পাবেন আমাদের সংবিধানে। অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতা, নাগরিকদের সাথে ধর্মীয় লৈঙ্গিক বা অন্য কোন কারণে বৈষম্য না করা এই সবকিছুই আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত। এমনকি যেসকল মতলববাজ রাজনীতিবিদরা সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইত্যাদি যুক্ত করেছে, ওরাও সংবিধানের মৌলিক চরিত্রটা বিঘ্নিত করতে চেয়েছে বটে, কিন্তু বৈষম্যবিরোধী বিধানগুলো থাকার ফলে সকল ধর্মের ও মতের লোকজনের অধিকার কার্যত অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে। ফলত এখন মুল দায়িত্বটা দাঁড়িয়েছে সরকারের- ওরা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে দেশের অসাম্প্রদায়িক চারিত্র্য বজায় রাখতে চান? ওরা কি দেশে নারীর স্বাধীনতা অন্তত ন্যুনতম মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত রাখতে চান?
সরকার যদি আসলেই দেশে অসাম্প্রদায়িকতা বজায় রাখতে চান তাইলে তো সরকারকে সেইভাবে কথা বলতে হবে, সেইভাবে আচরণ করতে হবে এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ও দৈনন্দিন সকল আচরণে সেই চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে।
সরকার কি সেই কাজটা করছেন? সেইরকম আচরণ করছেন? এইটা আপনারা বিচার করবেন। আমার সবিনয় মতামত হচ্ছে যে না, আমাদের সরকার ধর্মনিরপেক্ষ আচরণ করছেন না, নারীর প্রতি সহিংসতা বা মিসোজিনি নিরুৎসাহিত করে সেরকম আচরণ করছেন না। কেন এরকম বলছি সেটা কি উদাহরণ বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বুঝাতে হবে?
৩. রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে?
আর রাজনৈতিক দলগুলো? ওরা কি করছে? আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কথা বাদই দিলাম। এই দুই দলের যে কোন একটা পোস্টারের দিকে তাকালেই আপনি বুঝতে পারবেন এরা দুই দলই হচ্ছে মুসলমানদের পার্টি। দুই দলই এটা স্পষ্ট করে পোস্টারের শীর্ষে, ব্যানারের শীর্ষে বা মঞ্চের পেছনে যে পর্দা থাকে সেখানে লিখে রাখে। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত স্লোগান ছাড়া ওদের পোস্টার হয় না ব্যানার হয় না। মুসলমানদের ধর্মীয় স্লোগান লেখা পোস্টার বা ব্যানার বা কোন প্রকাশনা সেটা তো আর সকলের জন্যে নয়। কেউ যদি একটা ছোট বুকলেটের শুরুতেই জয় বজরঙ্গবলি বা শ্রীহরি সহায় লিখে রাখে, তাইলে সেই বুকলেট যে মুসলমান বা খৃস্টানের জন্যে নয় সেকথা কি ভেঙে বলতে হবে?
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলির কথা তো আলোচনার কিছু নাই। ওরা তো আনুষ্ঠানিকভাবেই সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। যেসব রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক নেতা বা রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীকে আপনি অসাম্প্রদায়িক ও নারীর অধিকারের প্রতি সংবেদনশীল মনে করেন ওদের অবস্থা কি? বলতে ভাল লাগছে না তবুও বলতেই হয়, এমনকি বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক দলগুলির মধ্যেও কি আপনি সাম্প্রদায়িকতা দেখতে পাবেন। নারীর অধিকার নিয়ে সিপিবি বাসদ ছাড়া অন্য কাউকে আমি স্পষ্ট করে ঠিক কথাটা বলতে শুনিনি। মওলানা ভাসানির অনুসারীদের মধ্যে তো সাম্প্রদায়িকতা থাকবেই, সেটা আমাদেরকে বিস্মিত করে না। কিন্তু ভয়ংকর আফসোসের কথা কি জানেন? এমনকি সিপিবির নেতা কর্মীদের মধ্যেও আমি মাঝে মাঝে দুই একজন দেখতে পাই যারা নানাভাবে পেঁচিয়ে পুচিয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিতে চান এবং । যাদের চেতনা মিসোজিনি দোষে দুষ্ট।
এই যদি হয় অবস্থা তাইলে দেশের মধ্যে একজন নারীকে যদি তার কপালে টিপ থাকার জন্যে বা সিঁদুর থাকার জন্যে বা পোশাকের ধরনের জন্যে বা এইরকম অন্য যে কোন কারণে হয়রানির শিকার হতে হয় তাইলে অবাক হওয়ার কিছু কি আছে? নাই। এই ধরনের ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার কিছু নাই।
৪ নারীর জন্যে মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের কোন সুযোগ নাই
বিস্মিত হওয়ার কিছু নাই, বিস্মিত হওয়ার প্রয়োজনও নাই। বরং এইরকম একেকেটা ঘটনা আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেয় যে নারীর জন্যে লড়াই করা ছাড়া মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের কোন সুযোগ নাই। একজন নারী যদি নিজেকে মানুষ মনে করেন তাইলে তাকে সারাজীবন লড়ে যেতে হয়। হয় লড়বেন অথবা দাসীবৃত্তি মেনে নিবেন। মাঝামাঝি কিছু নাই। আপনি যদি মনে করেন যে একজন পুরুষের মতো নারীও একজন মানুষ- তাইলে আপনি লড়বেন। লড়তে গিয়ে আপনি হয়তো লাঞ্ছনার শিকার হবেন, নির্যাতনের শিকার হবেন, মৃত্যুও হতে পারে। সেই মৃত্যু হবে একজন পূর্ণমর্যাদা সম্পন্ন মানুষের মৃত্যু।
আশু প্রতিকার হিসাবে এই পুলিশ কর্মকর্তার বিচার চাই। তার অবিলিম্বে গ্রেফতার চাই। ক্লোজ করা বদলি করা এইসব নয়- ফৌজদারি বিচার চাই, বিভাগীয় বিচার চাই। শাস্তি চাই। ফৌজদারি শাস্তি এবং বিভাগীয় শাস্তি হিসাবে চাকরী থেকে বহিষ্কার করা হোক ওকে। বিচারটা জরুরী কেননা বিচারটা না হলে ভুল বার্তা যাবে সারা দেশে সকল সাম্প্রদায়িক-পুরুষতান্ত্রিকদের মধ্যে। বিচার চাই।
উল্লেখ্য, ঢাকার রাস্তায় টিপ পারায় হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার। শনিবার সকালে এ ঘটনা নিয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন তিনি।
লেখক
আইনজীবী
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট