যিনি আমাকে দোপেঁয়াজা বানাতে শিখিয়েছিলেন, তিনি খুব রাগী মানুষ। তাঁর শেখানোর মাঝে প্রশ্ন করলে হেবি খঁচে যেতেন। সবাই কী আর ভালো বোঝাতে পারে! বলুন? আবার বাইরের ভাবভঙ্গী দেখে হতাশ হয়ে যাঁর থেকে বিন্দুমাত্র বোঝার আশা রাখি না, তিনি বুঝিয়ে চলে যাওয়ার পরেও মুগ্ধতা কাটতে চায় না। এখানেও অনেক হিসেব গোলমাল হয়ে যায়। পান্ডিত্য, ডিগ্রি, হম্বিতম্বি যতোই থাকুক না কেন একটা বিষয়কে সবাই সুন্দর এবং সহজ করে বোঝাতে পারেন না। তা সে রান্নার রেসিপি হোক বা কৃৎ প্রত্যয় আর তদ্ধিত প্রত্যয়ের পার্থক্য।
যিনি আমাকে দোপেঁয়াজা বানানো শিখিয়েছিলেন, তিনি দোপেঁয়াজা রান্নায় তিনরকমভাবে পেঁয়াজ প্রয়োগ করার কথা বলেছিলেন। রান্নার সূচনালগ্নে ঝিরিঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ তারপর বাটা পেঁয়াজ এবং রান্না কমপ্লিট হবার দু সেকেন্ড আগে পেঁয়াজের বেরেস্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছিনেন। আমি তাঁকে একটা নিরীহ প্রশ্ন করেছিলাম। তিনবার তিনরকমভাবে পেঁয়াজের প্রয়োগ সত্ত্বেও এর নাম ‘দো’ পেঁয়াজা কেন?
তিনি বেশ রেগে গিয়েছিলেন। মনোহরা ঘুষ দিয়েও তাঁর রাগ কমানো যায়নি। তবে নাম নিয়ে মাথা খারাপ না করে ডিম এবং চিকেন দোপেঁয়াজায় তিনরকমভাবে পেঁয়াজ প্রয়োগ করে দেখেছি দারুণ হয় খেতে। আদা রসুনের মাত্রাটা কম থাকে। টমেটো বা টকদই পড়ে না। পেঁয়াজ হয় মুখ্য। পেঁয়াজের নরম বিছানায় শুয়ে থাকে মুরগি কিম্বা হাঁসের ডিম। ওপরে বিছিয়ে দেওয়া হয় ঘিয়ে ভাজা বেরেস্তার চাদর। একচিমটে গরমমশলা দিয়ে কড়াই ঢেকে দিলেই হল। খাবার টেবিলে হাতে গরম প্রশংসাপত্র।
সাদা ভাত বা পোলাও সবের সঙ্গেই ফিট। হিটও। যাঁদের আজকাল ঝালে এবং ঝোলে আর তেমন মন লাগছে না, তাঁদের পছন্দ হবে দোপেঁয়াজা। শীতকালে মাছের ঝোল অতটা ভালো লাগে না। কিন্তু মাছ ভালোবাসি। তাই মাঝেমাঝেই মাছের দোপেঁয়াজা বানাই। এটা যেকোন মাছেই হবে। রুই,কাতলা,ভেটকি,সরপুঁটি,তেলাপিয়া সব মাছেরই দোপেঁয়াজা হয়।
কীভাবে বানাবেন
মাছগুলো শিলের পেছনের খরখরে অংশের ওপর ঘষে নিতে হবে ভালো করে। তারপর ধুয়ে পাতিলেবুর রস মাখিয়ে তিন চার মিনিট রেখে তারপর আবার ধুয়ে নুন,হলুদ,লঙ্কার গুঁড়ো মাখিয়ে রেখে দিতে হবে কিছুক্ষণ। ভাজার আগে এভাবে প্রস্তুতি নিলে দুপুর বারোটায় হাত দিয়ে মাছ খেলে রাত দশটা বত্রিশ মিনিটে হাত থেকে আঁশটে গন্ধ বেরোবে না। এরপর সর্ষের তেলে বেশ কড়া করে মাছগুলোকে ভেজে নিতে হবে।
মাছ ভাজার তেলে মাছ রান্না করলে সারা পাড়াময় কেমন একটা গা গুলোনো আঁশটে গন্ধ ওড়ে। তাই মাছ ভাজার তেলটা ফেলে দেওয়াই ভালো। ননস্টিক কড়াইতে অল্প তেল ভীষণ গরম করে তাতে মাছ ভাজলে মাছগুলো সুন্দরভাবে ভাজা হয় আর অবশিষ্ট তেলের পরিমাণ কম থাকে বা থাকেই না। এবার কড়াই মেজে বা অন্য কড়াইতে সর্ষের তেল গরম করে তাতে একটা তেজপাতা দিন। এবার বেশ অনেকটা পরিমাণে ঝিরিঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ (দু’পিস মাছ হলে বড়ো বড়ো চারটে পেঁয়াজ) তেলে ছাড়ুন। নুন দিন। নুন দিয়ে পেঁয়াজ ভাজার একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে। পেঁয়াজ সোনালী রঙ ধরলে এক টেবিল চামচ পেঁয়াজবাটা,এক চা চামচ আদারসুন বাটা দিন।
হলুদগুঁড়ো,কাশ্মিরী লঙ্কার গুঁড়ো,শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো,অল্প জিরের গুঁড়ো আর একটু জল দিয়ে মশলাটা কষুন। এই রান্নায় আলাদা করে চিনি দিতে হয় না। পেঁয়াজের মিষ্টতায় নুনমিষ্টির ভারসাম্য রক্ষিত হয়। এবার এর মধ্যে ভাজা মাছ দিয়ে পেঁয়াজের বিছানায় ঢুকিয়ে দিন মাছগুলোকে। আর একটু জল দিয়ে ঢেকে দিন। খানিকপরে ঝিরিঝিরি পেঁয়াজগুলো মাখনের মতো নরম হয়ে গেলে এবং গ্রেভিটা মাখোমাখো হয়ে এলে ছোট এলাচের গুঁড়ো এবং কয়েকটা চেরা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে গ্যাস কড়াইকে থেকে নামিয়ে নিন। রান্নাটাকে বিশেষ কারোর জন্য আর একটু স্পেশাল করতে চাইলে আর একটা কড়াইতে ঘি গরম করে ওতে ঝিরিঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ মুচমুচে করে ভেজে ওই মাছ রান্নার ওপরে ছড়িয়ে দিন।
দোপেঁয়াজার দো শব্দটাকে মান্যতা দেওয়ার জন্য আমি রান্নার শেষে তৃতীয়বার আর পেঁয়াজের বেরেস্তা ব্যবহার করিনি।