বাংলাদেশের অভিনেত্রী শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরিমনী মুক্তি পেলেন। অপরাধ ও বিচারের বাইরে বিগত ২৬ দিন ধরে এটাই প্রমাণ করার লাগাতার চেষ্টা চলেছে তার উপার্জনটা আসলে সে ‘অ্যাজ এ হোর’ করেছে। লকডাউনে বিদেশি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে গাড়ি নিয়েছে বা পেইড প্রস্টিটউশনের মধ্যে দিয়ে নিজের ঘর-বাড়ি- প্রতিষ্ঠা যাবতীয় করেছে। তার গ্রাম থেকে উঠে আসা, লড়াই করে কাজ পাওয়া, পেশা -পরিশ্রমটা আলোচনার বাইরের বৃত্তের। আমাদের সমাজে যে গাড়ি দেয় এবং যে নেয় তাদের দুই রকম বিচার বরাদ্দ করা হয়। পরিমনি সেই দৃষ্টিকোণের শিকার। ওম্যান হেটিং এবং ওম্যান বিউটি কন্সেপ্ট দুটিও মেল সুপ্রিম্যাসি কালচারের বাই প্রোডাক্ট। মেয়েদের অর্থনৈতিক প্রাচুর্য সবসময় অন্যের দান বলে ও ভেবে স্বস্তি পায় সমাজ। মেয়েদের প্রতিপত্তিকে খর্ব করতে ‘খারাপ মেয়ে’ ভেবে এক্সট্যাসি হয় অনেকের। পরিমনি নায়িকা হিসেবে বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। পুরস্কারও পেয়েছে বেশ কিছু। হিট সিনেমাও আছে তার। বাংলাদেশের এক নামী রাজনীতিবিদ ও বড় ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ আনার কিছুদিন পরেই বাড়িতে নিষিদ্ধ ড্রাগস ও মদ রাখার অভিযোগে গ্রেফতার হন পরিমনি। পরদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় তার চরিত্র ও জীবন নিয়ে কুৎসিত আলোচনা। এক পোশাকের ১২০ ঘণ্টার নিউজ হেডলাইন জুড়ে শুধু তার কাল্পনিক অ্যাডাল্টারির (ব্যভিচার)বর্ণনা।
এক মহিলা কমেডিয়ান শাজিয়া মির্জা মঞ্চে বলছিল তাকে এক দর্শক বলেছে- “তুমি কমেডি কর? তুমি প্রস্টিটিউড”। কমেডিয়ান বলেছিল প্রস্টিটিউড আর্ন করে পয়সা। সত্যিই তো! সে সেলার। যে কেনে তার লজ্জা না থাকলে যে বিক্রি করে তার জন্য শেইম আর স্টিগমা বরাদ্দ কেন? আসলে যৌনতার সম্মতি কেনা মানে শরীরের মালিকানা নয়। কন্সেন্ট ক্রয় করা মানেই নারী দেহ ও ব্যক্তিত্ব সেইলেবেল এটাও নয়। পরিমনিকে প্রস্টিটিউড বলে গালাগাল করছিল যারা তারা কো-ফেলোদের নিয়ে অভিযোগ করেনি কেননা তারা মনে করে পছন্দমত দেহ নির্বাচন করে কন্সেট কেনা পুরুষের অধিকার। তাই বদনাম হওয়ার ভাগিদার তারা নয়। পরিমনি বেশি করে আকাঙ্ক্ষিত। তাই সে বেশি ভিক্টিমাইজ এই স্ট্যান্ডটা কেউ নিলই না।
নারীর দুটি সংজ্ঞা সমাজ নির্ধারিত । ভালো মেয়ে। সে ভিক্টিমাইজ হবে। খারাপ মেয়ে । তার কপালে জুটবে চরিত্র খারাপ গুজবের শাস্তি। সর্বশেষ ভালো -খারাপ দুই ক্যাটাগরিই নালিফায়েড। এক পুলিশ অফিসার পরিমনিকে ভালবেসে সুবিধা করে দিয়েছেন তদন্তে আবার অন্য কেউ গাড়ি -টাকা ইত্যাদি দিয়েছেন এমন বড় বড় কানেকশন নিয়ে ব্যাপক গল্প চলল। ‘রাতের রানি’ বলে ঝড়ও উঠল। শুধু অন্ধকারের লোলুপ হায়নাগুলো দিনের রাজা থেকে গেল। একমাত্র পরিমনির শিক্ষক বলেছিলেন তিনি ওসব গসিপে বিশ্বাস করেন না। পরী এক মেধাবী ছাত্রী ছিল। একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীও।
অভিনেতারা বিশ্বব্যাপী দারুন সম্মান পান। ব্যাংক ব্যালেন্সও অনেক। কিন্তু অভিনেত্রীদের টাকা ও প্রপার্টি অনেকেই বিছানাগামী হয়েই অর্জন করেন এমনটাই প্রচারিত। কম্প্রোমাইজ করেই বড় ব্যানারে কাজ পান কথাটা প্রচলিত। কিন্তু সেই ব্যানার ও প্রজেক্টের ফাউন্ডাররা ‘দুধ সাদা’ থেকে যান। সম্প্রতি আমাদের এক সাফ্রন নেতা কাম বাবা বলেছেন মহিলা রাজনৈতিক নেত্রীরা নিজেদের উন্নতি করতে এক নেতার কাছ থেকে আরেক নেতার হাত ঘুরতে থাকে। বক্তব্যের সময় তার মুখের হাসি বলে দিচ্ছিল এক পুরুষ আসলে নানা পেশায় যুক্ত মহিলাদের ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে কী চোখে দেখে! ভাবনা বলে দিচ্ছিল মহিলাদের নিয়ে বডি পলিটিক্সের এই শেকড় কী মারাত্মকভাবে বসে রয়েছে ভেতরজুড়ে।
লেখক পরিচিতি– ফেমিনিজম ডট কমের এডিটর, কলামিস্ট ও ফেমিনিস্ট অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি ভারতের ব্রহ্মপুরের রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছেন।