একটি মামলার আপডেট জানতে এক সাংবাদিক আপা আসেন চেম্বারে। তিনি আমার প্রাক্তন কলিগ। আমরা একসাথেই কাজ করতাম একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে। আমার সেগুনবাগিচার চেম্বারে বসে কথা হচ্ছিল এক ভিকটিমের আইনগত সহায়তা প্রসংগে। আমার পরিচালিত “উইমেন জাস্টিস” নামের একটি সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ থেকে ওই ভিকটিমকে আমরা আইনগত সহায়তা দিয়েছি।
আমাদের চা আড্ডায় উঠলো কীভাবে শিশু / কিশোর /কিশোরীরা কিভাবে স্কুল কলেজে বুলিয়িং এবং হয়রানির শিকার হচ্ছে। “র্যাগিং কালচার” যেন একটি নিত্যদিনের সাধারণ ব্যাপার। অনেক বাবা মা নাকি বুঝতেই পারেননা স্কুলের যাওয়ার পর থেকে তাদের চঞ্চল বাচ্চাগুলো কেমন জানি চুপসে যাচ্ছে। যেহেতু বাব-মা দুজনেই চাকরি করছেন তাই তারা বাচ্চাটিকে সেইভাবে সময় দিয়ে কারণ অনুসন্ধান করতে পারেননা। বাচ্চাটিও আগের মতোন আর স্কুলের প্রতি ভালোবাসা কিংবা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কেমন যেন উদাসীন হয়ে থাকে আর শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায় তারাও নাকি বিষয়টিকে সেইভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি।
বাচ্চাটা অকারণে বাসায় রাগারাগি করে, অল্পতেই কান্নাকাটি জুড়ে দেয়, এবং খাতায় সব সময় কিছু মানুষের প্রতিকৃতি স্ক্যাচ করে আবার কাটাকাটি করে। বাচ্চাটির ব্যাপারে বাবা মা যখন সচেতন হলো একটু দেরিই হল বৈকি। বাচ্চাটি অনেক জ্বর নিয়ে হসপিটালে এডমিট। পরে তার এক বন্ধুর সাথে কথা বলে জানা গেলো তাদের বাচ্চাটি মোটা হওয়ার কারণে তাকে বুলিয়িং করা হত। সে নাকি ক্লাস রুমে ঠিকমতো তার টিফিনটিও খেতে পারতো না। অন্য বাচ্চাগুলো তাকে বলতো “হাতি কম খা ফেটে যাবি” আরো নানা রকম মন্তব্য করতো। বাচ্চাটা খুব আতংকে থাকতো এবং তার পড়াশুনার প্রতি কোন আগ্রহ ছিলো না, রেজাল্টও তেমনই খারাপ। বাবা মা জানার পর সেই বিখ্যাত স্কুল থেকে বাচ্চাকে এনে একটি সাধারণ স্কুলে দেয় এবং আস্তে আস্তে বাচ্চাটিকে স্বাভাবিক জীবনে আনতে বাবা মা এখন নিজেই সময় দিচ্ছে।
এতোবড়ো ঘটনা বলার একটাই কারন আর সেটি হলো বুলিং/ র্যাগিং / হ্যারাসমেন্ট স্কুল কলেজের একটি নিয়মিত আয়োজন। আয়োজন এই কারণেই বলছি আপনি খবর নিয়ে দেখবেন আপনার ছেলে মেয়ে স্কুল কিংবা কলেজ ইউনিভার্সিটিতে যেকোনো সময় অবশ্যই একবার না একবার তার সহপাঠী কিংবা সিনিয়র দ্বারা বুলিয়িং এর শিকার হচ্ছে। স্কুল /কলেজ/ ইউনিভার্সিটিতে একটা বিশাল গ্রুপই থাকে যারা এই ধরনের কাজ করে। আমি নিজেও অনেকবার আমার স্কুল / ইউনিভার্সিটি লাইফে বুলিং এর শিকার হয়েছি।
বগুড়ার বিচারকের মেয়েই সব অপরাধ করেছে তার সাথে কিছু হয়নাই এমন ভাবার কোন কারণ নেই। সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়ালের নামে যা দেখলাম তাতে বুঝতে বাকি নেই এইখানেও একটা সিন্ডিকেট কাজ করেছে তাদের হাতিয়ার ছিলো সাধারণ ছাত্রী বনাম জাজের মেয়ে। মনে হল মেয়েটিরই কপাল পুড়েছে যে সে কেনো জাজের মেয়ে হয়ে জন্ম নিলো? জাজের মেয়ে না হয়ে যদি অন্য কারো মেয়ে হতো ঘটনাটা অন্যরকম হেডিংও হতে পারতো।
সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম অনেকে বলছেন মেয়েটির জন্য একটা আলাদা স্কুল বানাতে? কেনো সে তার ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দিলো? কেনো অন্য ছাত্রীর মাকে পা ধরালো? এইরকম অদ্ভূত অনেক কিছুই উঠে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। আমরা কোন রকম সত্যটা যাচাই-বাছাই না করেই এক পক্ষকে সব সময় দোষী ভাবি।
একজন নারী বিচারক সারাদিন যখন তার দায়িত্ব পালন করায় ব্যস্ত। তিনি শুনলেন তার মেয়েটি স্কুলে বুলিয়িং এর শিকার এবং তার মেয়ের নাক দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে তখন কোন মায়ের মানসিক অবস্থা ঠিক থাকে? এছাড়া বগুড়ার স্কুলের ঘটনায় কিছু ছাত্রীর নিউজ ফুটেজ দেখলাম তারা খুব এগ্রেসিভ, এমনকি মিডিয়ার সামনে বারবার জাজের মেয়ে বলে কটাক্ষ করছিলো। এতে অনেকটাই অনুমান করা যায় মেয়েটি আসলেই বুলিয়িং এর শিকার। আচ্ছা ধরুন ওই জাজের মেয়েটিই যদি বুলিয়িং এ অতীষ্ট হয়ে কোন অঘটন ঘটাতো? এই আমরাই ফেসবুকে হ্যাশট্যাগ দিয়ে লিখতাম “নো মোর হ্যারাসমেন্ট, উই ওয়ান্ট জাস্টিস”।
এভাবে মিডিয়া ট্রায়ালে কোন ঘটনার সত্যতা বা অসত্যতা নিরুপণ করা যায় না। সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল একরকমের বুলিয়িং। আমাদের আরও বিবেচনাবোধ সম্পন্ন হওয়া উচিত।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
বি:দ্র: উইম্যানভয়েসবিডিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব মতামত।