নুরজাহান মুন্না ইসলাম
সবাই স্পেশাল শিশুর কথাই শুনেছেন অথবা জানেনও। কিন্তু স্পেশাল মায়ের কথা শুনেছেন কখনো? হ্যা আজ আমি আপনাদের একজন স্পেশাল মায়ের কথাই বলব। তিনি আমার মা। আমার মা কানে শুনতে অক্ষম, কথা বলতেও অক্ষম। ছোটবেলায় পোলিও হয়ে একটা পা শুকিয়ে কাঠের মতো পাতলা ও সরু হয়ে গিয়েছে। তিনি খুব ভালোভাবে হাঁটতেও পারেন না।
আমরা এই মুহূর্তে ঢাকার একটা হলরুমে বসে আছি। আর কিছুক্ষণেই মাকে সেরা উদ্যাক্তার পুরস্কার দেওয়া হবে। সেখানে আমার মাকে তার অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে ইশারা ভাষায়। ছোটবেলা থেকেই মায়ের সব ভাষা আমি বুঝি। তাই আমাকেই মায়ের বক্তব্য সবাইকে অনুবাদ করে বলতে হবে।
এ সফলতার পথটা মোটেই মসৃণ ছিল না, হয়ত সফলতার পথ মানেই কঠিনতম কিছু। আমার শৈশব মধুর ছিল না। আমাকে প্রতিবেশিরা ‘বোবার ছেলে’ বলে ডাকতো অথচ তারা আমার মায়ের নাম জানতো। কি তাচ্ছিল্য ছিলো! না আমি বাবাকে কোনদিন দেখিনি। মাকে গিয়ে যখন বলতাম মা শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে কথা বলতে চেষ্টা করতেন। ঐ দৃশ্যটা খুব বেদনার। মাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম আমার এই মাই ভালো।
আমার নানা নানির প্রথম সন্তান আমার মা। নানার আর্থিক অবস্থা চলনসই ছিল। আমার মায়ের জন্মের পর নানা খুশি হয়ে নাম রাখলেন ‘কথা’। অথচ ছয় মাস পরেই উনারা জানতে পারলেন তাদের মেয়ে কথাই বলতে পারে না। প্রথমে মনখারাপ করলেও একসময় তারা মেনে নিলেন। নানি মেয়েকে অনেক আদর করতেন। ৫ বছর বয়সে পোলিও হয় আমার মায়ের। সেই থেকে ভালোভাবে হাঁটতে পারে না। এরপর আমার নানা নানির আরেকটি ছেলে হয় এবং সেও প্রতিবন্ধী হলো। কিন্তু সেই ছেলে একবছর বয়সে পুকুরে পড়ে মারা যায়। নানা খুব ভেঙ্গে পড়েছিলেন। নানি তখন আমার মাকে নিয়েই সারাদিন থাকতেন। প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্য গ্রামের সবাই কথা শোনাতো। নানা নানি লেখাপড়া জানত না। তাই প্রতিবন্ধী মেয়েকে কিভাবে বড় করবেন সেই ধারণাই ছিল না। এমনিই সাধারন অক্ষরজ্ঞান দিয়েছিলেন। তবে আমার মা ছোটবেলা থেকেই নিজের আগ্রহে দেখে দেখে সেলাই শিখেছেন এবং বিভিন্ন নকশা আঁকতে পারতেন। এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন। নানা তেমন শিক্ষিত না হলেও অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন। তাই আত্মীয়-স্বজনের বা প্রতিবেশিরা কে কি বলতো তা পাত্তা দিতেন না।
একদিন এক বিয়ের প্রস্তাব আসল আমার নানার কাছে। নানা নানি কেন যেন খুব আবেগী হলেন। ভাবলেন সব কিছু জেনেও যে তাদের মেয়েকে বিয়ে করতে চায় চায় সে নিশ্চই অনেক বড় মনের মানুষ হবে। কিন্তু তারা ভুল ভেবেছিলেন। আমার বাবা, দাদা, দাদি কেউকেই আমি কোনদিন দেখিনি। ইচ্ছাও নেই। শুনেছি বিয়ের ৬ মাস পর আমার বাবা আমার মাকে ফেলে চলে যান। এবং শর্ত দেন সব সম্পত্তি লিখে দিলেই কেবল তিনি ফিরে আসবেন। নানা নানি এক পর্যায়ে রাজিও হয়েছিলেন কিন্তু আমার মা খুব শক্ত হয়ে গিয়েছিল। ততদিনে আমি মায়ের পেটে পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায়। নানা নানির ভয় ছিল আমিও প্রতিবন্ধী হয় কী না! প্রতিবেশিরা ভয় দেখাচ্ছিল নানা নানিকে!
অবশেষ এক বৃষ্টির রাতে আমার জন্ম হলো। ছেলের নাম রাখা হলো ‘বর্ষণ’। আমি হলাম সেই ছেলে! আমি কাঁদলে মা শুনতো না। নানির কাছে শুনেছি রাতে আমার মা সারাক্ষণ আমার মুখের দিয়ে তাকিয়ে থাকত। কখন জাগি এ শংকায়! আঙ্গুলের সাথে রশি বেঁধে রাখতেন আমার পায়ে যাতে নড়লেই টের পান!
আমি অল্প বয়সে অনেক কিছু শিখে গেলাম। মা যেহেতু কানে শুনতে পেতোনা আমার নানি আমাদের সাথে বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন। আস্তে আস্তে আমি বড় হতে লাগলাম। একটু একটু বুঝতে লাগলাম আমার মা অন্য সব মায়ের মত নয়। ৪ বছর বয়স থেকেই আমি ইশারা ভাষায় কথা বলতে পারি। আমার মায়ের সব কথা আমি বুঝি। স্কুলে যাওয়ার সময় আমার মাকে আমি সাথে নিয়ে যেতাম। আমার মা যখন কথা বলার সময় অদ্ভূত রকম আওয়াজ করত বা খুঁড়িয়ে হাঁটতো , অনেক বন্ধুরা হাসাহাসি করত। আমি যখন মেট্রিক পাশ করি তখন নানা মারা যায়। নানিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমার মা কিছুটা লিখতে এবং পড়তে পারত।
নানা মারা যাওয়ার পর উনার ভাইয়েরা সব সম্পত্তি দখল করে নেয় শুধু এই ঘরভিটে ছাড়া। একসময় আমাদের টাকা পয়সার অভাব দেখা দেয়। নানির চিকিৎসা, আমার লেখাপড়া। সম্পদ বলতে শুধু একটুকরো ভিটে। আমার মা হাত মেশিন দিয়ে কাপড় সেলাই করত। খুব সুন্দর নকশীকাঁথা সেলাই করত। নিজেই ডিজাইন আঁকত। আমি অবাক হয়ে যেতাম কারন এগুলো তো মাকে কেউ শিখাইনি!
একদিন এক ঘটনা ঘটলো। আমি তখন বিএ পরীক্ষা দিয়ে চাকরি খুঁজছি। পাড়ার এক আন্টি আসলো নকশিকাঁথা কিনতে। দুটা পছন্দ করে মায়ের হাতে ২ হাজার টাকা দিলো। ব্যপারটা আমার সামনেই ঘটলো। আমার মা কিছুই বললো না। কারণ মায়ের কোন চাহিদা ছিল না। যে যেমন টাকা দিত সেটাই নিতো। আমিও বিষয়টা ভুলে গেলাম।
পরদিন মা আমাকে টাকা দিয়ে নানির জন্য অসুধ আনতে বললেন। আমি অষুধ আনতে বের হয়ে কিছুটা সামনে যেতেই দেখি ঐ আন্টিটা আমার মায়ের কাছ থেকে কেনা নকশিকাঁথা দুটি ৫ হাজার করে আরেকজনের কাছে বিক্রি করলেন। মানে ৮ হাজার টাকা লাভ! দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। কারণ বিষয়গুলি নিয়ে কখনো আমি ভাবিনি। আমার মাথায় চাকরি পাওয়ার চিন্তা। আমি কয়েকটা টিউশনি করে যা ইনকাম করি তাতে ভালোভাবে চলে না বলে মা কাপড় সেলাই করে, নকশীকাঁথা বানায়। আমি কখনো সেভাবে এই বিষয়টা নজর দিইনি। পাড়ার সবাই মায়ের কাছেই কাপড় সেলাই করে। (হয়তো কম দামে পায় বলে) যে যা দাম দেয় মা তাই রাখে। এই সুযোগে মাকে সবাই ঠকিয়ে যাচ্ছে!
আমি খুব দ্রুত কিছু একটা চিন্তা করে ফেল্লাম। ঘরে গিয়ে মাকে সব কিছু বললাম। মা খুব মন খারাপ করলো। আমাকে বলার চেষ্টা করলো সবাই তাকে বোকা ভাবে।আমি মাকে বুঝালাম। বললাম আমি যা বলব তা করবে কিনা। মা আমার কথায় সম্মতি দিল। আমার আর মায়ের যা যা খুচরা টাকা ছিল সব এক করলাম। প্রায় ৩০ হাজার টাকার মতো হয়েছে। পরের দিন বাড়ির ছোট একটি খালি জায়গায় একটা ছোট ঘরের কাজ শুরু করলাম। একটা পায়ের মেশিন কিনলাম। দুইজন মহিলা ঠিক করলাম। একজন মা কাপড় মাপ অনুযায়ী কাটবে, আর সে সেলাই করবে। আরেকজন মা নকশা এঁকে দিবে, আর সে সুঁই সুতোয় তা সেলাই করবে। যদিও প্রথম প্রথম মা নিজেই বেশি কাজ করত। আস্তে আস্তে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমার মায়ের কাজের কথা শুনলো। আমরা অন্য সবার চেয়ে দাম একটু কম রাখতাম। মা কাজ করতো আর আমি চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে মায়ের ব্যবসার হিসাবের দিকটা দেখতাম। দোকানের নাম মায়ের পছন্দমত রাখলাম ‘কথার বর্ষণ’।
এই ৫ বছরে আমাদের মা ছেলের ব্যবসা আজ অনেকটাই উন্নতি করেছে। পরিধিও বেড়েছে। এখন প্রায় একশ মেয়ে কাজ করে আমাদের সাথে। এক বছর আগে নানি মারা যায়। আমরা আমাদের ভিটায় একটা একতলা বাড়ি করেছি। যারা ছোট কালে বোবার ছেলে বলে আমাকে খ্যাপাতো তারাই আজ সমীহ করে!
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মায়ের নাম মাইকে ঘোষণা করলো। আমি আর মা উঠে মঞ্চে গেলাম। প্রধান অতিথি মাকে ক্রেস্ট ও মেডেল পরিয়ে দিলেন। উপস্থাপিকা মাকে কিছু বলার অনুরোধ করলেন। আমার মা কোনদিন এতো মানুষের সামনে আসেনি। তিনি ঘাবড়ে গেলেন। আমার দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকলেন। আমি মাইকের সামনে আসলাম, সারা হলরুমে পিনপতন নীরবতা! সবাই একজন বোবা মায়ের কথা শোনার জন্য উদগ্রীব। মা আমার পাশে দাঁড়িয়ে ইশারায় বলতে লাগলেন, আমি মাইকে মায়ের বর্ণনা মতো বলে যেতে লাগলাম….
‘আমার নাম কথা, কিন্তু আমি কথা বলতে পারিনা, আমি কানেও শুনিনা, আমার ছোট বেলায় পোলিও হয়েছে তাই আমি খোঁড়া। ভালো করে হাঁটতেও পারিনা। আমি কোনদিন আমার মাকে মা বলে ডাকতে পারিনি। আমার একটা ভাই ছিল সেও প্রতিবন্ধী ছিল। এক বছর বয়সে সে পুকুরে ডুবে মরে যায়। আমি ছোট বেলা থেকে পাড়া প্রতিবেশিদের খারাপ আচরণ পেতাম। কেউ আমার সাথে মিশতো না, খেলত না। আমি মেয়ে তাই বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার মা বাবা আমার বিয়ের চেষ্টা করল। যেখানে ভালো ভালো মেয়েদের বিয়ে হয় না সেখানে আমাকে কে বিয়ে করবে? আমি আমার মাকে বুঝাই সেই কথা। আমার আগ্রহে একজন মহিলার কাছে আমি এই হাতের কাজ গুলি শিখি। টাকার লোভে একজন পুরুষ আমাকে বিয়ে করলো সব জেনেই। কিন্তু কয়েকদিন পরেই সেই লোক তার ভুল বুঝতে পারলো। কয়েক মাস আমার সাথে থেকে সে চলে গেল। ততদিনে আমার এই ছেলে আমার পেটে! আমার ছেলের বাবা নামের লোকটা চেয়েছিল আমাদের বাড়িটা তার নামে লিখে দিলে সে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু আমি তা হতে দিইনি। তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।এরপর আমি আমার ছেলেকে জন্ম দিলাম। আমার ছেলে খুব অল্প বয়স থেকে আমার কথা বুঝত। আমিও বুঝতাম। বৃষ্টির রাতে হয়েছিল তাই নাম দিয়েছি বর্ষণ। আজ এই পুরষ্কার আমার বর্ষণের প্রাপ্য। আমার ছেলের শৈশবও অনেক পীড়াদায়ক ছিল সেটাও আমার জন্য! আমি যে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম সেই যুদ্ধে আজ হয়ত জিতেছি। কিন্তু তারপরও আমি আজ মনের যুদ্ধে হেরে গেছি। কারন আমি কোনদিন আমার ছেলের মুখে মা ডাক শুনতে পারবো না! ছেলে নাম ধরে ডাকতে পারবো না! এই ডাক শুনতে কেমন! জানতেই পারব না! আমি তোর একজন বোবা মা!!! কখনো চিৎকার করে বলতে পারবো না বাবারে তোকে খুব ভালোবাসি….
আমি কাঁদছি, মা ও কাঁদছে, দর্শক সারিতে বসা সবাই দাঁড়িয়ে মাকে হাত তালি দিয়ে অভিনন্দিত করলো। আমি চোখ মুছলাম। সবাই সন্তানের জন্য গর্বিত হয় কিন্তু আমি আজ আমার মায়ের জন্য গর্বিত। মা কে জড়িয়ে ধরে বললাম আমার এই মা ই ভালো। তুমি আমার স্পেশাল মা, আমার শ্রেষ্ঠ মা!
লেখক- আইনজীবী