করোনার মহামারি ঘাতকের রূপ ধরেই এসেছে বিশ্বজুড়ে। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড রোগী পাওয়ার পর আমরা কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হতে থাকি। বৈশ্বিক এই মহামারিতে ৩ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন। আমাদের দেশে সংক্রমিতর সংখ্য ও সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন আমরা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর খবর শুনছি। ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ছিল। কিন্তু আমরা সঠিকভাবে মেনে চলতে পারিনি অথবা তোয়াক্কাই করিনি।
৩১ মে থেকে স্বল্প পরিসরে আবার সব শুরু হয়েছে। মানুষকে বের হতেই হচ্ছে। যারা ঘরে ছিলেন, তারাও এখন আর ঘরবন্দী থাকতে পারছেন না জীবন আর জীবিকার জন্য।
মনে রাখবেন কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা মানেই শুধু উপসর্গের চিকিৎসা। নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই। এ জন্য বিশ্বের গবেষণাগারগুলো প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। কোনো আশার কথা এখনো শোনা যায়নি।
আপনি যদি করোনায় এখনও আক্রান্ত না হন,তাহলে কি করবেন?
প্রথমত আপনি যেন আক্রান্ত না হোন সেজন্য সকল সতর্কতা অবলম্বন করুন। এটাই চিকিৎসার প্রথম ধাপ। মাস্ক ব্যবহার করুন সঠিকভাবে। থুতনিতে বা নাকের ডগা বের করে মাস্ক পরা বন্ধ করুন। মাস্কে হাত দেবেন না। সার্জিক্যাল মাস্ক পরতেই হবে তাও নয়। আপনি কাপড়ের তৈরি তিনস্তর বিশিষ্ট মাস্ক পরতে পারেন। কারণ এটা প্রতিদিন ধোয়া যায়। সার্জিক্যাল মাস্ক ঠিকমত না ফেলে না দিলে বরং আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ে। এ মাস্ক যত্রতত্র ফেলে রাখাও নিরাপদ নয়। সার্জিক্যাল মাস্কের বাইরে করোনাভাইরাস ৭ দিন এবং ভেতরে ৩দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আপনি যদি মাস্ক ঠিকমত ব্যবহার না করেন এটাই হতে পারে আপনার জন্য সংক্রমণের উৎস।
যদি আক্রান্ত হয়ে যান?
নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করুন। একটা ঘরে পারলে আলাদা বাথরুম ব্যবহার নিশ্চিত করুন। বাড়িতে পালস অক্সিমিটার রাখুন। অক্সিজেনের মাত্রা দেখুন। অক্সিজেন সিলিন্ডারও রাখতে পারেন। চিকিৎসকের পরামর্শমত ওষুধ গ্রহণ করুন।
যদি অবস্থা গুরুতর হয়?
যদি অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে, অন্যান্য গুরুতর উপসর্গও থাকে তবেই হাসপাতালে ভর্তি হোন। মনে রাখতে হবে উচ্চমাত্রার অক্সিজেনের ব্যবহার করলে এবং অন্যান্য চিকিৎসা সঠিকভাবে করতে পারলে রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন। রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। তাই হাসপাতালে রক্ত তরল রাখার চিকিৎসা শুরু করা হয়। সেকেন্ডারি ইনফেকশন কাভারেজে রাখার জন্য ইঞ্জেকটেবল এন্টিবায়োটিক শুরু করতে হয়।
এন্টিবায়োটিক ভাইরাসের বিরূদ্ধে প্রয়োগ করা হয় না। শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন চিকিৎসার জন্য এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
আপনার চিকিৎসকই সিদ্ধান্ত নেবেন প্লাজমা থেরাপির প্রয়োজন আছে কী না? তবে অক্সিজেনের মাত্রা দেখে সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে পারলে আইসিইউ বা ভেন্টিলেটর নির্ভরশীল হওয়া অনেকটাই ঠেকানো যেতে পারে।
কী করবেন না?
নিজে নিজে ওষুধ খাবেন না। প্রতিটি ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। সেটি আপনার জন্য হিতকর নাও হতে পারে। আপনি একাধারে সব ওষুধই খেলেন। ক্ষতি কিন্তু আপনারই।
মানসিক প্রস্তুতি রাখুন
এখন আর ‘আমি আক্রান্ত হবো না’ ভাবার অবকাশ নেই। যে কোন সময় যে কোনোভাবেই আপনি আক্রান্ত হতে পারেন এই প্যানডেমিকে।
যারা বাড়ির বাইরে যান, তারা উপসর্গ না থাকলেও নিজেকে আলাদা রাখুন। বিশেষ করে বাড়ির বয়স্কদের নিরাপদ রাখুন।
আপনি যেহেতু ঘরের বাইরে যান, আপনি জানেন না কোনো কোভিড রোগী আপনার সংস্পর্শে এসেছে বা আসেনি কী না। উপসর্গহীন কোভিড আপনি চিনবেন না, জানবেনও না। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সুরক্ষার কৌশল ছাড়া উপায় নেই।
নিজের হাত দুটোই শত্রু
মনে রাখবেন আপনার প্রথম শত্রু আপনার হাত দুটো। কোনো কিছু ধরলেই হাত পরিষ্কার করুন। মাস্ক, ৬ ফুট দূরত্ব, বারাবার সাবানে হাত ধোয়া, হ্যান্ড স্যানিটাইজার সাথে রাখার কথা একেবারেই ভোলা চলবে না। চিহ্নিত শত্রুর মোকাবেলা সহজ যদি আপনি বিধি-নিষেধ মেনে চলেন। কোনোভাবেই অপরিষ্কার হাত আপনার চোখ মুখ বা নাকের (টি জোন) কাছে নেওয়া যাবে না।
অভ্যাস বদলে ফেলুন
হাইজেনিক অভ্যাস গড়ে তুলুন। বাইরে থেকে ফিরে কাপড়চোপড় সাবানে ভিজিয়ে রাখুন। আগের অভ্যাসগুলো ত্যাগ করুন। এক কাপড় একদিনই পরবেন। বারবার নয়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে বদলে ফেলুন
জুতা পরিষ্কার করুন।
কম জিনিস ব্যবহারে অভ্যস্ত হোন।
খুব সাধারণ জীবন যাপনের জন্য নিজেকে মানিয়ে নিন।
কোথাও যেতে গণপরিবহন ব্যবহার না করে হেঁটে যান।
প্রফুল্ল রাখুন নিজের মনকে।
যার যার ধর্মীয় কাজগুলো করুন।
সাইকেল,মোটর সাইকেল ব্যবহার করুন।
ব্যক্তিগত যানবাহন নিজে চালিয়ে যান।
ড্রাইভার (অন্যান্য সকল সাহায্যকারী) বাড়িতে বা অফিসে নির্ভরতা কমিয়ে আনুন।
প্রয়োজন না থাকলে ঘরেই থাকুন।
শুধু একটা কথা ভাবুন। এখন সময়টা বেঁচে থাকার। নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর আস্থা রাখুন। শতকরা ৮০ জন ঘরে থেকেই সুস্থ হয়ে যাবেন। বিশ্বাস করুন। মনোবল রাখুন। মানসিকভাবে শক্ত থাকুন। এখন সময় ভয়কে জয় করার। ভয়কে জয় মানে অসাবধান হওয়া নয়। প্রয়োজনীয় ভয় থাকুক কারণ ভয় না পেলে সচেতনতা বা সাবধানতা আসে না।
ইনশাআল্লাহ আঁধার কাটবেই।
লেখক: ফারহানা নীলা পেশায় চিকিৎসক। তিনি জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।