ফেসবুকে লেখার কারণে অনেক নারী আমাকে ক্ষমতাধর বা খুব সাহসী নারী ভাবেন। তারা ভেবে বসেন আমি তাদের পরিবার বা তারও বাইরের সব সমস্যায় ‘আসমান ও জমিনের সকল মুশকিল আসানকারী’। এরকমটা ভেবেই তারা যোগাযোগ করেন। ফোন করে বিভিন্ন সমস্যা জানান। প্রাত্যহিক মৌখিক নির্যাতনের শব্দগুলো তাদের মুখে শুনে আমি নিজের কল্পনায় সেগুলোকে দৃশ্যমান করে তুলতে পারি। কেউ কেউ ঘটনা সম্পর্কিত নথিও পাঠিয়ে দেন। কিছু হয় নিউজ উপযোগী কিছু নয়। তবুও তারা বলেন।
নিউজ উপযোগী কেন নয়?
অনেক ঘটনার বর্ণনায় আমি বুঝে ফেলি এসব ঘটেছে। আসলেই ঘটেছে। তবে এটি মামলা দায়েরের জন্য প্রাথমিক উপযুক্ত প্রমাণাদি নেই। একই কারণে সেগুলো নিউজও হতে পারে না। দুটো উদাহরণ দিই।
১. স্বামীর যৌন ওরিয়েন্টেশন হল তিনি পুরুষে আগ্রহী। ওই কারণে একটি সন্তানের জন্মের পর তার সাথে স্ত্রীর কোন যৌন বা মানসিক সংযোগ নেই। তবে ভারবাল অ্যাবিউজ আছে। মারধর আছে। স্ত্রীর বেতনের টাকা কেড়ে নেওয়ার ঘটনা আছে। স্ত্রী সামাজিকভাবে সম্মানিত পরিবারের মেয়ে বলে এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। এবং কোন প্রতিকারও তিনি চাইতেন না। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কারণ ওই লোক নিজের আট বছর সন্তানকেও যখন নির্যাতন শুরু করেন। এ বিষয়ে প্রমাণ না থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রমাণ করতে হলে ঘরকে বিগবসের ঘরের মতো ক্যামেরায় জড়িয়ে রাখতে হবে। সেটি নিউজ বা মামলা কিছুই হল না।
২. একজন অল্পশিক্ষিত নারী স্বামীর অ্যালকোহল আসক্তি ও অশ্রাব্য ভাষার গালাগাল ও মারের কারণে ডিভোর্স না করে নিজের প্যারেন্টসের কাছে থাকতেন। ওই স্বামী শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ভাংচুর করত। মারধরে মেয়েটি বারবার সিভিয়ার ইনজুরিতে পড়ত। কিন্তু সংসার টেকানোর দায়ে তিনি কখনও ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে গিয়ে একবারের ইনজুরিও রেকর্ড করেননি। শেষে স্বামীর অনৈতিক সম্পর্ক সামনে এলে অনেকটা চুপি চুপি ডিভোর্স দিয়ে বাবা মায়ের ঘরে ফেরেন। মামলার জন্য সময় অতিবাহিত হয়েছে। মারপিটের কোন মেডিক্যাল রিপোর্ট নেই। দোষীর শাস্তি না হওয়া ভিকটিমের জন্য কতোটা ট্রমার হতে পারে ওই মেয়েটিকে দেখে আমি বুঝেছি।
৩. উইম্যান ভয়েস শুরুর প্রথম পর্যায়ে এক ভদ্রলোক মেসেজ করেন তার ৭০ বছরের বাবা ৫৬ বছরের মাকে পেটান। কেবল তিনি স্বশরীরে উপস্থিত থাকলেই তার বাবা বিরত থাকেন। ভদ্রলোক খুব উচ্চপদের কর্মজীবী। কিন্তু মায়ের বিষয়ে তিনি অসহায়। বাবার প্রতি ভালবাসার কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না। আবার মাকে বাঁচানোর কোন উপায়ও দেখেন না। আবার বাবা মায়ের ডিভোর্স তিনি চাইতেন না।
ঘরোয়া নির্যাতন কেবল স্বামী নয় নিজের বাবা মা ভাইবোনও করতে পারে
এ বিষয়ে আমার মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে হয়।
একটি মেয়ের সাথে কথা হয় যাকে তার বাবা মা অপয়া বলত। ও বাড়ির যেকোন বিপদ তার কারণে এসছে বলত। মেয়েটির শৈশব কাটে নির্দয়ভাবে পেটানো ও অশ্রাব্য গালাগাল শুনে। একটা মানুষের লজ্জা নিবারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু পোশাকও তাকে দেওয়া হত না। পুরনো দুই জামায় তার বছর পার করতে হত। ঘরের ও কৃষি জমির সব কাজ তাকে দিয়ে করানো হত। তবে মেয়েটির পিঠেপিঠি ভাইয়ের জীবন একেবারে উল্টো।
একদিন মেয়েটিকে তার বেদম পিটিয়েছিলেন কারণ সব কাজ করার পর খিদে পেলে সে সবার আগে গরম ভাত খেয়েছিল। ‘আবাড়া ভাত’ খাওয়া তার জন্য মানা ছিল।
আরেকটা মেয়ের মা। নাম ধরে নিই কুলসুম। স্বামীর মৃত্যুর পর কুলসুম আরেক বিয়ে করে নতুন স্বামীকে ঘরে তুলেন পুরনো স্বামীর ভিটেয়। বারো না পেরোনো সাজিয়া নামের মেয়েটিকে আমার বাসায় আনা হয়েছিল কাজের মেয়ে দিতে। মেয়েটি নামের মেয়ে। কুলসুমের নতুন স্বামী সৎ কন্যাকে অপছন্দ করে৷ ঘৃণা করে। তাই ১২ বছরের মেয়েটিকে তারই বাবার বাড়ি থেকে বের করলেন মা ও তার নতুন স্বামী। মেয়েটির মা মেয়েকে কাজের মেয়ে দিয়ে আয় করতে চাইছিলেন। ঘরেও থাকল না টাকাও আসল। পাঁচদিন মেহমানের মত রেখে বুঝিয়ে কুলসুমের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এত ছোট মেয়েকে আমি না রাখলেও জানি না কুলসুম তাকে অন্য বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে দিয়ে দিয়েছেন কী না।
মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যৌতুক পাঠানো
যৌতুকের অনেক ব্যপার এখন স্বেচ্ছায় হয়। বিশেষত বাবা মারা ছেলেকে বাধ্য করেন কন্যার বাড়িতে এটা সেটা পাঠাতে। বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায় এসব পুরুষেরা নিজের স্ত্রী ও পরিবারের মৌলিক চাহিদাটুকুও না দিয়ে বোনের জন্য এসব করেন বা করতে বাধ্য হন। ফলে ওই বাড়িতে আসা বউটিকে বাধ্য হয়ে বাবার বাড়ির সাহায্য বা যৌতুক নিতে হয়। কন্যার জন্য এই ভালবাসা কী আসলে কন্যার জন্যই?
অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি কেবল বাড়িতে আসা বউটি ভাল থাকুক সেটা কিছুতেই মানতে পারেন না শ্বশুরবাড়ির অনেকে।
শাশুড়ি নির্যাতন
যৌতুক প্রথার অস্তিত্ব আছে তার মানেই এমন নয় যে কেবল বউরা নির্যাতিত হচ্ছেন। মধ্যবয়স্কা বধূর হাতে নির্যাতেনের শিকার হচ্ছেন শাশুড়িরাও। শাশুড়িকে তীর্যক মন্তব্য অকারণে মৌখিক নির্যাতন এমনকী মারধর করেছেন এমন ঘটনাও আমি দেখেছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওই নির্যাতক বধূরা ক্ষমতা পান স্বামীর কাছ থেকে। এমন বয়সের বৃদ্ধারা প্রয়েজনীয় চিকিৎসা সুবিধাটুকুও পান না।
স্বামী দেশে নেই। টাকা পাঠানো হয় স্ত্রীর অ্যকাউন্টে। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। এরকম গঠনের পরিবারগুলোতে শাশুড়ির উপর নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে।
নারীর ওয়ার্কপ্লেস
ওয়ার্কিং জোনে নারীকে মেরুকরণ করা। আলাদা বোঝানো। নারী সন্তান ধারণ করে, নারীর শিশু আছে এসব বিষয় নিয়ে তীর্যক মন্তব্য শোনার ঘটনা অহরহ। খারাপ পর্যায় হল নারীকে সৌন্দর্য বিচারে ক্যারিয়ার দক্ষতা বিচার করা। এর থেকেও খারাপ হল সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট করা। এর থেকেও খারাপ স্লাট শেমিং করা। এতগুলো ঘটনার সমন্বয় হল নারীর ওয়ার্কপ্লেস।
পোশাকের স্বাধীনতা
বাংলাদেশে ওই অর্থে অশ্লীল সেক্সুয়ালিটি প্রদর্শন অনেকটাই নাই বলা যায়। এদেশের মেয়েরা যা পরে সেটা আপাত ভদ্র ও এই সমাজের কোন পোশাক ফরম্যাটকে চ্যলেঞ্জ করে না। পার্থক্য হিজাব নিকাব পরে নাকী পরে না দিয়ে হয়।
হিজাব পরলেও দোষ হয়। পুরুষ যে মেয়েকে নাগাল পেতে চায় তার হিজাব পরা বা রিজিড মানসিকতা মানতে পারে না। যে মেয়েকে নাগালের বাইরে রাখতে চায় তাকে আবার হিজাব পরাতে চায়। এই বিষয়টা হল সুবিধা করতে পারা আর না করতে পারার পার্থক্য। পুরুষ নারীর পোশাক নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ঘরনারী ও নিয়ন্ত্রণ চায় সে তার ঘরনারী ও পরনারীকে কী পরাতে চায়?
এখানে নারীর চয়েসটা কোথায়?
অসহনশীল সমাজ
ভিকটিম বা সারভাইবর নারী সবচেয়ে বেশি ভয় পায় কাকে জানেন? এবিউজারকে নয়। সমাজকে। সমাজ নামের আস্ত পুরুষকে। ভিকটিম ভয় পায় তাদের সবাইকে যাদের সাথে তিনি ভিকটিমহুডের তথ্য শেয়ার করেন। শেষে এসে দেখা যায় ভিকটিমের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে তারাই যারা তাকে সাপোর্ট দেওয়ার কথা বলেছিল।
একজন চল্লিশোর্ধ্ব নারী আমাকে রক্তারক্তি মুখের ছবি পাঠান। এবং প্রায় পাঠান। স্বামীর মারধরের। কিন্তু স্পষ্ট জানান তিনি কোন আইনি অ্যাকশন চান না। চাকরি চান না। তিনি কেবল এসএসসি পাশ করেছেন। খুব নিচুমানের চাকরি তিনি করতে পারবেন না। তিনি মূলত অর্থ সহায়তা চান। তিনি টাকা ধার চান ২০ হাজার নিদেনপক্ষে ৫ হাজার।
ওই নারী আমাকে বলেন, ‘এসব জানালে মানুষ আমার দোষ আগে ধরবে। সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারব না।’ তাই তিনি ওই অ্যাবিউজারের সাথে মার খেয়ে খেয়ে থাকতে চান। ভিকটিম ব্লেমিং ও সামাজিকভাবে অপদস্থ হওয়ার ভয় নারীকে খুন হয়ে যাওয়ার মুহূর্তেও তাড়া করে।
তাকে বুঝাতে পারিনাই যে পৃথিবীতে এমন কোন দানবীর নাই, এমন কোন সরকারি পলিসি নাই যাতে কেবল সহায়তার উপর নির্ভর করে তিনি একই আর্থ সামাজিক মর্যাদায় জীবনযাপন করবেন। সুতরাং কাজ করে খাওয়া ছাড়া গতি নাই।
অর্থনীতিতে নারীর প্রবেশাধিকার
নারীরা দেশে থাকা চাকরি ও ব্যবসায় সুযোগ বা একসেস পান খুব খুব কম। নাই ও শূন্য। এটা বলতে গবেষণা লাগে না। যার যার ওয়ার্কপ্লেসে নারীকর্মী আর পুরুষকর্মী র্যাশিও করলেই জেনে যাবেন।
এই রকম ফ্যাসিলিটি ছাড়া দেশে নারী খুব গতিশীলতায় অর্থনীতিতে প্রবেশ করবে। রাতারাতি বের হবে অ্যাবিউসিভ সম্পর্ক থেকে এটা কল্পনা ছাড়া কিছুই না। নারীবিরোধী বিশাল একটা যন্ত্রের একটা ক্ষুদ্র স্ক্রু হচ্ছে ডোমেস্টিক ভায়লেন্স। এটা সমস্যা তবে আসল সমস্যা না।
এই অভিজ্ঞতাগুলো উইম্যান ভয়েসবিডির কাজ করতে ও নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে এটা সেটা লিখতে লিখতে হয়েছে। কোন তত্ত্ব না পড়ে দুই লাইন ঘটনাকে ঘটনার মত বলে যাওয়া ছাড়া আমার কোন ক্ষমতাই নাই। আর নারী বিষয়ক পোর্টাল মানে সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটাই চড়ুইভাতি টাইপের ব্যপার। ছোটখাট থাক, সাজো গোজ, রাঁধো বাড়ো ঘরানার কাজ।
আর নারীবাদ?
বিশ্বজুড়ে যত ধর্ম যত পুরুষ আছে সবাই নারীবাদ বিরোধী। অনেক নারীও তাই। তারাই নারীবাদ নিয়ে ভুল প্রপাগান্ডা ছড়ান। নারীবাদ কেন নারীর সাধারণ অধিকারের দাবিও যদি একটু শক্তভাবে তোলা হয় তাদের পুরুষতন্ত্রের কাঠগড়ায় করজোড়ে দাাঁড়াতে হয়।
সিংহ শিকারী গল্প লেখে তার সিংহবধের সফলতার গল্প। সিংহ যতদিন বলতে জানেনি ততদিন একতরফা ওই গল্প প্রচারিত হয়েছে। শিকারী কখনো চাইবে না সিংহের হাতেও একটি অস্ত্র থাকুক। নিজেদের উপর আক্রমণ তারা নিজেরাই প্রতিহত করুক। পুরুষ চেয়েছে পুরুষ নিজেই আক্রমণ করবে আবার তারাই রক্ষাকর্তা হয়ে নারীকে নিরাপত্তা দেবে। নারীর স্বকীয়তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।