তালিবানরা যখন দ্রুতবেগে ধেয়ে আসছিল কাবুলের দিকে তখনও তিনি দমে যাননি। তিনি ফেসবুক-টুইটার ও ইন্সটাগ্রামকে তার চিত্রশিল্প প্রচারের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। তালিবানরা কাবুল পৌঁছে গেলে তিনি সোশ্যাল মাধ্যমে হঠাৎ করেই নিরব হয়ে যান। এতে তার ভক্তসহ অনেকেই তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে যায়। সেপ্টেম্বরে তিনি আবারও তার কাজ নিয়ে ফিরে এসেছেন সোশ্যাল সাইটগুলোতে। নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি এখন কোন সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন না তবে নিশ্চিত করেছেন তিনি নিরাপদেই আছেন।
এতক্ষণ যার কথা লিখছি তিনি শামসিয়া হাসানি আসল নাম অম্মলবানিন হাসানি। শামসিয়া হাসানি হলেন আফগানিস্তানের প্রথম নারী গ্রাফিতি শিল্পী যিনি তালিবান জংগীদের ভয় ও হুমকিকে উপেক্ষা করে অবদমিত ও পীড়িত নারীর না বলা শব্দগুলোকে ছবি করে কাবুল শহরের দেয়ালগুলোকে রাঙ্গিয়ে দিয়েছিলেন। তালিবানরা তখন সরকার ছিল না তবুও দেশটির কট্টর ইসলামপন্থী আচরণে শিল্পের উপর নিষেধাজ্ঞা ও ওই দেশে নারীর অবস্থা ছিল করুন ও দুর্দশার। নারীর কথাগুলোকে তুলে ধরেছেন দেয়াল শিল্প দিয়ে। তার কথায় যুদ্ধে যুদ্ধে দেয়ালগুলো বিদ্ধস্ত করার চেয়ে শিল্পের রঙ দিয়ে অনুচ্চারিত কথাগুলো বলাই শ্রেয়। শিল্পকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেন শান্তির রুপ হিসেবে।
তার সাম্প্রতিক দুটো ছবি সোশ্যাল মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। একটি ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন যেখানে আফগানি নীল বোরখায় জড়ানো ভীত সন্ত্রস্ত এক নারী পিয়ানো বুকে জড়িয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পেছনে অন্ধকার ও বন্দুকধারীদের কালো ছায়া।
অন্য ছবিতে দেখা যায়, মুখে তার রক্তের আচড় আকাশ নীল পোশাকের নারীটি আলো ধরে দাড়িয়েছে এক কালো পোশাকের সহিংস বন্দুকধারীর সামনে। নারী যেন স্বাধীনতায় বাচে তারই করুণ প্রার্থনা।
তার আকা ছবিগুলোর অভিব্যক্তি এখন আফগান নারীদের জন্য সাহস ও আশার কথাই বর্ণনা করে। ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে তার পোস্ট করা ছবিগুলোতে হাজার লাইক ও শেয়ার হয়েছে। ফেসবুকেও তাই।
গত কয়েক বছরে শামসিয়া হাসানি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত হন ও তার কাজ সাফল্য একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ৩৩ বছর বয়সী আফগানি এ শিল্পী আফগানিস্তানের প্রথম নারী গ্রাফিতি শিল্পী ও তিনি হয়ে উঠেছিলেন নারীর জন্য একটি সাহসী কণ্ঠ ও পরিচিত হয়ে উঠেছেন তার সাহসী শিল্প প্রচারের জন্য। তিনি উত্তর আমেরিকা, ইউরোপীয় এবং এশিয়ান দেশগুলোতে আর্ট গ্যালারি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন।
তিনি ২০১০ সালের ফরেইন পলিসির শীর্ষ ১০০ গ্লোবাল চিন্তাবিদদের তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন এবং বিশ্বব্যাপী তার ছবিগুলো নারীর অধিকারের জন্য গেম-চেঞ্জিং হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। গ্রাফিতি চিত্রগুলো নিয়ে তার প্রকাশিত দুটো বই সর্বোচ্চ সংখ্যক বিক্রিত বই হিসেবে বিবেচনার অধিকার রাখে।
গত আগস্টে যখন তালেবানরা একের পর এক আফগান প্রদেশগুলোর ক্ষমতা দখল করছিল অবশেষে কাবুল দখল করে নেয় তখন তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিত হন তার কাজ নিয়ে। কাবুলের তার হাজার নারী অনুসারী তার নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করেছেন।
বেশিরভাগ নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন এমন একটা ভীতিকর পরিস্থিতিতে ছবি প্রকাশ করা একটি সাহসী পদক্ষেপ। তাদের মতে তালিবানরা নারীদের জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং মারাত্মক শাস্তির বিধান প্রতিষ্ঠা করবে যেমনটি তারা ৯০ এর দশকে তাদের শাসনের সময় করেছিল।
এমন সময়ে নারী শিল্পীরা দ্বিগুণ বিপজ্জনক অবস্থার সম্মুখীন হতে পারেন। কারণ তালিবানদের মতে ইসলামে শিল্পের জন্য কোন অনুমোদন নেই ও নারীর জন্য তা একেবারেই নেই।
ছবিতে নারীকে দৃশ্যায়িত করা ও নারী সম্পর্কে কট্টর ধারণা বদলানো এ গ্রাফিতি শিল্পী ইরানের এক শরণার্থী দম্পতির ঘর আলো করে জন্মেছিলেন ১৯৮৮ সালে। হাসানি ২০০৫ সালে আফগানিস্তানে ফিরে আসেন ও কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রকলা এবং ভিজ্যুয়াল আর্টসে স্নাতক শেষ করেন। ২০১০ সালে গ্রাফিতি এবং স্ট্রিট আর্ট শুরু করেছিলেন
পুরুষ শাসিত আফগানের ওই বদ্ধ সমাজে নারীর জন্য অনিরাপদ ও কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি রঙএর কৌটা নিয়ে দেয়াল ও সড়কে স্প্রে করা শুরু করেন তখন থেকেই তিনি তার কাজের ক্ষেত্রে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
সত্যিকার অর্থে আফগান নারীদের মুখোমুখি চ্যালেঞ্জগুলো প্রকাশ করতে জন্য তার গ্রাফিতির ক্ষমতা ছিল অনন্য।
তিনি বদলে দিতে চেয়েছিলেন আফগানের মানুষের নারী নিয়ে ধারণাকে। হাসানি তার শিল্পকে তালিবান এবং অন্যান্য চরমপন্থী গোষ্ঠীর আক্রমণের সরাসরি জবাব দিতে ব্যবহার করেছেন। তিনি নারীর ব্যথা ও ক্ষতির তীব্রতার ভাষাকে চিত্রে রুপান্তর করেন।
একই বছরের মে মাসের একটি ধূসর রঙের ছবিটি একটি প্রসূতি ওয়ার্ডে মারাত্মক আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় তৈরি করা হয়েছিল।
সামশিয়া হাসানি তার আকা ছবিতে নারীর অবস্থানকে আবেগের একটি বিস্তৃত পরিসর হিসেবে দেখিয়েছেন।নারীর আকাঙ্ক্ষা, অস্বীকার, আশা এবং হৃদয় ভাঙা, স্বাধীনতা এবং ভয়কে তিনি ঝলমলে রঙ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। তার বেশিরভাগ ছবিতে নারীর সামনে বাধার দেয়াল পেছনে অন্ধকারের ভয় ফুটে উঠেছে। চাবুকের আঘাতে নারীর মাথার স্কার্ফের নিচ থেকে বেকিয়ে বেরিয়ে আসা চুলকে তুলনা করা যায় মেডুসার সাথে।
ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে সামশিয়া বলেন “আমি ছবিতে নারীর হাতে থাকা বাদ্যযন্ত্রকে নারীর কণ্ঠের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরি। মানুষের সাথে কথা বলতে মনোযোগ পেতে একটি উচ্চকণ্ঠ লাগে। নারীর হাতের বাদ্যযন্ত্র একটি উচ্চস্বরের প্রতীক। নারীর কথা শোনা হয় না তাই তার যন্ত্রটি তার উচ্চকণ্ঠ হবে।
তার আকা অনেক ছবিতে নারীর চোখ বন্ধ থাকে কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, নারীর চোখ বন্ধ কারণ নারীর চারপাশে নারীর জন্য দেখার কিছু থাকে না। চারপাশে নিষেধের দেয়াল। এজন্য নারীর মুখাবয়বে আমি কোন শুভ ভবিষ্যত দেখাইনা।