
ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় বইমেলা।২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রামেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। বাংলা ভাষার প্রতি আবেগ ও ভালোবাসায় মেলা প্রাঙ্গণ জমে ওঠে লেখক পাঠকের মিলনমেলায়। করোনার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টিকে মাথায় রেখেই চট্টগ্রাম নগরের এম.এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়াম চত্বরটি উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে লেখক পাঠকের সরব উপস্থিতিতে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদসহ চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের উদ্যোগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০২২। মেলায় স্টল বরাদ্দ হয়েছে ১২০টি। মেলা শেষ হওয়ার কথা রয়েছে আগামী ১০ মার্চ তবে সময় বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন মেলা কৃর্তৃপক্ষ।
বইয়ের স্টলে পাঠকের ভীড় ও বইমেলার মাঠ জমেছে লেখক পাঠকের আনন্দ আড্ডায়। এ বছর চট্টগ্রামে অনেক নতুনেরা লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। মেলায় নারীর উপস্থিতিও লক্ষ্যণীয়। নারী লেখক, নারী প্রকাশকসহ অনেকেই বইমেলার আনন্দবার্তা দিয়েছেন উইম্যানভয়েসবিডিকে।
মেলায় গিয়েই পেয়ে গেলাম কেবল নারীদের লেখা বইয়ের স্টল। উদ্যোক্তাও একজন নারী প্রকাশক।তিনি রেহানা চৌধুরী, প্রজ্ঞালক প্রকাশনীর কর্ণধার। এবারের বইমেলায় তিনি অন্যরকম উদ্যোগটি নিলেন। সারাদেশের প্রায় ১০০ নারী লেখকের বই নিয়ে স্টল দিলেন বইমেলায়। তার স্টলের নামও নারী লেখক।
লেখক ও অনুবাদক ফারজানা রহমান শিমু বলেছেন, ‘নারীর জন্য সুযোগ তৈরি করতেই এবারে নারী লেখক নামের আলাদা বুক স্টল যা ইতিপূর্বে কেউ করেননি। তার লেখা বইগুলো হল ফ্রিডম ইজ নট ফ্রি (অনুবাদ গ্রন্থ), কাছে নয় দূরে, দরজা খুলেই ছুট, লাল সাদা নীল।

‘আমার গ্রামের আমিই প্রথম নারী যার বই প্রকাশ হয়েছে’
ভোলার লালমোহন উপজেলার মেয়ে ইসরাত জাহান পান্না। ‘কুমড়ো ফুলের দিনে’ নামের কবিতার বই প্রকাশ করে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। নিজেকে গ্রামের মেয়ে বলে পরিচয় দিলেন উইম্যানভয়েসবিডিকে। তিনি বলেছেন, ‘আমি যেই গ্রাম থেকে এসেছি সেখানে নারীদের অনেক নিঁচু করে দেখানো হয়। আমার গ্রামের আমিই প্রথম নারী যার বই প্রকাশ হয়েছে।এমনকি আমিই প্রথম নারী গ্রাম থেকে স্কুলজীবন শেষ করে শহরে এসে পড়ালেখা করছি।গ্রামের এমন কোন মেয়ে নেই যারা পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছে।তাই আমি নিজেকে এমনভাবে গড়তে চাইছি যাতে আমাকে দেখে তারা শিখতে পারে, কলম ধরতে পারে। তারা যাতে বুঝতে পারে একজন মানুষ হিসেবে সমাজে বেঁচে থাকার জন্য শিক্ষা নারীর জন্য কতটা দরকার।
ফেসবুকের লেখালেখি দিয়েই পরিচিত হয়েছিলেন অভয়াচারিণীর লেখক দোলনা বড়ুয়া তৃষা। তিনি উইম্যানভয়েসবিডিকে বলেন, ‘মূলত নারীদের জীবন নিয়ে লিখি।নারীদের নৈমিত্তিক ছোট ছোট ঘটনা আমার গল্পের উপজীব্য। ২০২২ সালে বইমেলায় প্রকাশিত আমার প্রথম উপন্যাস ‘অভয়চারিনী’তে একজন ডিভোর্সী নারীর সংগ্রামের জীবন নিয়ে লিখেছি ।
‘অর্বাচীনের উপাখ্যান ও অন্যান্য’—গল্পগ্রন্থের লেখক তকিব তৌফিক বলেছেন, ‘এ বছরের বইমেলায় আমার বই প্রকাশ পেয়েছে বইয়ের প্রথম গল্পটির নাম হচ্ছে ‘গোঁড়া সমাজের জলসাঘর’ যেখানো হয়েছে সমাজের গোঁড়ামির কারণে নারী কতটা অসহায় গ্রামে গঞ্জে তারা কেনো পিছিয়ে পড়ছেন। পুরুষরা চাইলেই করতে পারে কিন্তু নারীরা যখন করতে চায় তখনি সমাজের গোড়ামির শিকার হয় তখনি তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় এবং তাদেরকে পিছিয়ে পড়তে হয়। আমরা চাই যে গোড়া সমাজের জলসা ঘর ভেঙে , সব ধরনের প্রতিবন্ধকা দূর করে নারীরাও পুরুষের মতো এগিয়ে আসুক ও সমাজে ভূমিকা রাখুক।
মেলায় পেয়ে যাই শিশু পাঠক সায়ন্তী চক্রবর্তীকে, ‘বাবা মায়ের সাথে বইমেলায় ঘুরতে এসেছি।বইমেলায় গল্পের বই সংগ্রহ করতে এসেছি আমি অনেক খুশি।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক হোসাইন কবির বলেছেন,‘মহান একুশকে কেন্দ্র করে এই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়।এটি আমাদের মননচর্চার সাথে সম্পৃক্ত।
নারী লেখকদের নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারীদেরকে এখনো যথেষ্ট পিছিয়ে রাখার বা অবদমন করার একটা প্রক্রিয়া বলবৎ রয়েছে। অগ্রসর চিন্তার নারী লেখকরা আগেও ছিলেন যেমন মালেকা বেগম, বেগম রোকেয়া। তারা প্রগতির পক্ষে লেখালিখি করেছেন ।নারীদের সচেতন হতে হবে শুধু লেখালেখি দিয়ে নয়। কী লিখবেন সেটা নিয়েও ভাবতে হবে।নারীদের অধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।’
নারীবাদী লেখক অ্যাকটিভিস্ট মহূয়া ভট্টাচার্য উইম্যান ভয়েস বিডিকে বলেন, ‘এবারের বই মেলায় পাঠক সমাগম তুলনামূলকভাবে বেশি। বিশেষত ছুটির দিনগুলোতে নারী পাঠকরা বেশি আসছেন। বেশি বিক্রি হচ্ছে কবিতার বই এবং গল্পের বই।’
হেপা সংগঠনের সাহায্য নিয়ে এসেছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের একটি দল। তাদের মধ্যে বইমেলা নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করেন মোরসেদা আক্তার মৌসুমি। মৌসুমীর কথায়, ‘আমাদের অনেক ইচ্ছে ছিলো বইমেলাতে আসবো কিন্তু এসে কি হবে আমি তো দেখতে পাবো না, পড়তে পারবো না।তবে হেপা সংগঠন আমাদের দ্বিতীয়বারের মতো বইমেলা অনুভব স্বপ্নটা পূরণ করেছে।
মেলায় আসা নৃত্যশিল্পী রাজ রাজশ্রী উইম্যানভয়েসবিডিকে বলেছেন ‘বইমেলায় এসেছি ভালো লাগছে। নতুন নতুন নারীদের বই দেখছি ভালো লাগছে। আমি লেখকদের আহবান করবো আপনারা সাহিত্য, কবিতা গল্প , উপন্যাস নিয়ে লেখেন খুবই ভালো লাগে সাথে যদি সাংস্কৃতিক অঙ্গন(নৃত্য, গান) নিয়ে লিখেন আমরাও উপকৃত হবো।
মেলায় যান। বই কিনুন, বই উপহার দিন, বই পড়ুন। বই বন্ধু বই মনের অন্ধকারকে দূর করে।