জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়া। হুইল চেয়ার থেকে যদি ঘাড়টা যদি একটু কাত হয়ে যায়, সেটিকে তিনি নিজে তুলতে পারেন না। কাউকে তুলে দিতে হয়। সারা শরীরে তিনি কয়েকটি আঙ্গুল ছাড়া কিছুই নাড়াতে পারেন না। খাওয়া থেকে ঘুম তার সবকিছুতেই নির্ভরতা এক মায়ের উপরই। শব্দ নিয়ে না খেলে যদি সোজা বলি তবে বলতে হয় মহুয়া একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী। শরীরে থাকা মেরুদণ্ডে কোন বল নেই কিন্তু বেঁচে থাকা ও অর্জনে তিনি ঠিক শিরদাঁড়া উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী এক মানুষ।

জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়া। হুইল চেয়ার থেকে যদি ঘাড়টা যদি একটু কাত হয়ে যায়, সেটিকে তিনি নিজে তুলতে পারেন না। কাউকে তুলে দিতে হয়। সারা শরীরে তিনি কয়েকটি আঙ্গুল ছাড়া কিছুই নাড়াতে পারেন না। খাওয়া থেকে ঘুম তার সবকিছুতেই নির্ভরতা এক মায়ের উপরই। শব্দ নিয়ে না খেলে সোজাসাপ্টা বলতে গেলে তিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। শরীরে থাকা মেরুদণ্ডে কোন বল নেই কিন্তু বেঁচে থাকা ও অর্জনে তিনি ঠিক শিরদাঁড়া উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী এক মানুষ। পাবনায় জন্ম তার। বেড়ে উঠেছেন বগুড়া শহরে।

এসএসসির পর এইএইচএসসিতেও জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়ে মহুয়া এখন দেশিয় পণ্যের বিপণন করেন। একজন উদ্যোক্তা। তার কথায়— যখন শুরু করেছিলাম তখন শখ হিসেবেই নিয়েছিলাম। আমার মনে হয় শুধু চাকরি দিয়ে কোন মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে পারে না। তারপর আমার রেইনবোর যাত্র শুরু হল। দেশিয় পণ্যের প্রসার মানে দেশের উন্নয়ন। কাজটি চ্যালেঞ্জিং হলেও আমি এভাবেই এগিয়ে যেতে চাই। আমি বিশেষত উইম্যান অ্যান্ড ই কমার্সে গ্রুপের (ফেসবুক গ্রুপ) রাজিব আহমেদ স্যারের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অণুপ্রাণিত হয়েছি।
মহুয়ার কথা
মহুয়া বলেন, আমার যখন বয়স ৯ মাস তখন থেকে আমার পরিবার বুঝতে পারে আমি শারীরিকভাবে স্বাভাবিক নই। তারপর থেকে তারা আমাকে অনেক হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। অনেক চেষ্টা করেছেন আমার জন্য। একটা সময় তারাও জানতে পারেন আমার শারীরিক সমস্যা জন্মগত। পারিবারিক জিনের কারণেই এটা হয়েছে। তখন থেকেই আমার মায়ের আমাকে নিয়ে লড়াই শুরু। আমার বড়ভাইয়ের অনেক অনেক অবদান আছে। আমি পরিবার থেকে সব সুযোগই পেয়েছি, যা একটি স্বাভাবিক সন্তান পায়। এজন্য আমার মাকেও আমার সাথে বন্দি হতে হয়েছে। তিনি সবসময় আমার সঙ্গেই থাকেন।
মহুয়া বলেন, ‘শুরুতে আমার বাবা চাননি আমি স্কুলে যাই। সেটি আমার নিরাপত্তার জন্যই তিনি বলেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব। এরপর আমি কেঁদেছিলাম অনেক। আমার কান্না দেখে আমাকে বাবা প্রতিবন্ধীদের স্কুলে পড়তে বলেছিলেন। আমার জেদ ছিল আমি স্বাভাবিক স্কুলেই পড়ব। আমি পড়েছি সেটা আমার বড়ভাই ও মায়ের কারণে সম্ভব হয়েছিল। রেজাল্ট ভালো হওয়ার পর বাবা আমাকে বিসিএস ক্যডার বানাতে চেয়েছিলেন। আমি হয়েছি উদ্যোক্তা। আমি বলব জীবনের লক্ষ্যপূরণ কোন মেটিভেশনাল স্পিচ দিয়ে হয় না, এটা একটা দীর্ঘ প্রস্তুতি। মহুয়ার কথায়—‘মাই লাইফ ইজ নট মেকিং অ্যা বিজনেজ, ইটস এ প্রিপারেশন।’

আমার পরিবার আমাকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখেছে, স্বাভাবিক মানুষের মত আচরণ করেছে। যেটা অনেকেই পায় না। আমি সেদিক দিয়ে খুব ভাগ্যবান বলতে পারেন। আমি আমার মায়ের মত মা আর আমার বড় ভাইয়ের মত ভাইকে পেয়েছি। যারা আমাকে কোন কিছুর অভাব বুঝতে দেননি। যাই করতে চেয়েছি তাই করতে দিয়েছেন।— যোগ করেন মহুয়া।
মহুয়া বলেন, ‘এখন আমি মাস্টার্স করছি পাশাপাশি দেশি পণ্য নিয়ে ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিয়েছি। রেইনবো আমার অনলাইন পেজের নাম। প্রথম দিকে এটি আমার শখ থেকে করতাম। হাতে ডিজাইন বানানো আমার শখ। নিজের ডিজাইন করা পোষাকগুলো অনলাইনে বিক্রি করতাম। এখন আমি ডিজাইন করে নিজস্ব কারিগর দিয়ে পোষাক বানাই। এ দুয়েকমাসেই আমি দেড় লাখ টাকার পোষাক বিক্রি করেছি। এখন আমি লন্ডন ও অস্ট্রেলিয়া থেকেও অর্ডার পাচ্ছি। এটা উইয়ের কারণে সম্ভব হয়েছে।’
‘আমাদের দেশিয় শিল্প মানে কুটির শিল্প। এতে বাংলার আবহমান সংস্কৃতির একটা ছায়া থাকে। এ শিল্পের নির্মাতা পল্লী অঞ্চলের মানুষ। বাংলার প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখি, লতাপাতা, গাছপালা, নদ-নদী ও আকাশ কুটির শিল্পের ডিজাইনে বা মোটিফে দেখা যায়। ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধরে এভাবে ধরে রাখে এমন জাতি আপনি পাবেন না।’
‘দেশি পণ্য নিয়ে আমার স্বপ্ন বড় হয়েছে ফেসবুকভিত্তিক একটা গ্রুপের (উইমেন অ্যান্ড ই কমার্স) মাধ্যমে। বলতে পারেন প্রায় অর্ডার আমি সেখান থেকেই পেয়েছি। গ্রুপের অ্যাডমিন খুবই উল্লেখযোগ্য দুজন মানুষের কথা বলতেই হয় রাজিব আহমেদ স্যার ও নিশা আপু। আমি ব্যবসায়িক জ্ঞান মূলত সেখানেই পেয়েছি।’
মহুয়ার মা
মহুয়ার মা সাহেরা সাহেরা খানম বলেন, ‘আমার মেয়েকে আমি কখনও নিজেকে অস্বাভাবিক ভাবতে দিইনি। আমিও ভাবিনি। ওর বাবা ব্যংকার ছিলেন। ঘরে খুব একটা সময় দিতে পারতেন না। গত বছর গত হয়েছেন। তিনিও মহুয়াকে নিয়ে খুব গর্ব করতেন।’
‘হ্যা ওকে এক্সারসাইজ করানো, খাওয়ানো ঘুম পাড়ানো এসব কাজ আমাকে করতে হয়েছে। কিন্তু আমার মেয়েটা এতো ব্রিলিয়ান্ট সে এইসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে। বগুড়ার শাহ সুলতান কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স শেষ করেছে। ওখানেই মাস্টার্স ভর্তি হয়েছে। এমন মেয়ের জন্যে কিছু করলে সেটাকে কী করে কষ্ট ভাববো বলুন।’

সাহেরা খাতুন বলেছেন, ‘একটা জিনেটিক কারণে ওর জীবন থেমে যাবে সেটা আমি হতে দিতে চাইনি।
আমার মেয়েটা যাই করতে চাইতো তাই করতে দিয়েছি। ঝড় হোক বা বৃষ্টি তার যেখানে যাওয়ার কথা নিয়ে গিয়েছি। এজন্য অনেক এক্সিডেন্টও হয়েছে। জীবন যুদ্ধটা আমি তাকে করতে দিয়েছি। আমার মেয়েটা এতো ব্রিলিয়ান্ট সে এসএসসি এইসএসসি দুটোতেই জিপিএ ৫ পেয়েছে। সে পড়তে খুব পছন্দ করে। কবিতা পড়ে গল্প পড়ে খুব সুন্দর করে আবৃত্তিও করে। একটা হাতের কয়েকটা আঙ্গুল দিয়ে সে জীবনে যা করতে চেয়েছে সফল হয়েছে। সে আরও অনেকদূর এগিয়ে যাক সে দোয়া করি। ’
মহুয়ার শিক্ষক
মহুয়ার শিক্ষক জেবুন্নেছা জেবা বলেছেন, ‘জীবনের প্রতি ওর যে তৃষ্ঞা ,জীবনকে উপভোগ করার ওর যে আগ্রহ তা বিস্ময়কর। অদ্ভূত নেতৃত্বের গুণ আছে তার। বন্ধু মহলে মহুয়াই লিডার । অনার্স শেষ করে ওর বন্ধুরা যখন জীবন নিয়ে ভীষণ অনিশ্চয়তায় ভুগেছে তখন এই মেয়েটি তার নিজের ব্যবসা শুরু করেছে অনলাইনে । তাও তার কাজ দেশি পণ্য নিয়ে। আঙ্গুল দিয়ে ও কলম ধরতে পারে। সেটুকু দিয়েই কাপড়ে সুন্দর নকশা আঁকে। তারপর সেটি সেলাই করে। এখন সে হাতের কাজের পোষাকের ব্যবসা করছে। অর্ডার পাচ্ছে দেশের বাইরে থেকেও। আমার মন বলে ও আরও অনেক দূর যাবে।’
মহুয়ার বড় ভাই
মহুয়ার বড় ভাই ঢাকার ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক মো. গোলাম মোস্তাফা বলেন, ‘মহুয়া সবকিছু তার নিজ উদ্যোগেই করেছে। আমরা কিছু কিছু সাপোর্ট করেছি মাত্র। পড়াশোনায়ও ভালো। দেশি পোষাক নিয়ে কাজ করবে বলায় আমরাও তাকে সমর্থন দিয়েছি। তবে জীবনের সব বড় পরীক্ষাগুলো দিয়েছেন আমাদের মা। এই যে ছোটবেলা থেকে আস্তে আস্তে ও যে বড় হয়েছে মানুষ হয়েছে সব মায়েরই অবদান। স্কুলে নিয়ে আসা যাওয়া, তার খাওয়া দাওয়া, টিওশনিতে যাওয়া সব আমার মায়ের সাথেই হুইল চেয়ারে করে মুভ করেছে। অ্যান্ড একচুয়েলি পড়াশোনাও তার সাথে আমার মাও করেছে। ’
তিনি বলেন, ‘আমাদের বগুড়ার বাড়ি থেকে তার কলেজ ৩ কিলোমিটার দূরে। আমার মাই তাকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে যেতেন নিয়ে আসতেন। দোতলায় ক্লাস থাকলে তার বন্ধুরা মিলে দোতলায় উঠিয়ে দেয়। টিউশন পড়তে গেলে মা সাথে যায়। এখন তো মহুয়া প্রতিদিন ৪ কিলোমিটার দূরে গিয়ে কোচিংও করে। তার কিছুতে আমার মার কখনও কোন না নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনাকে আমি বলে রাখি আমার এই ছোট বোনের জন্যই ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে প্রথম প্রতিবন্ধীদের জন্য এক্সট্রা টাইম ক্লাসের ব্যবস্থা করেছি আমি। এর আগে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এটা ছিল না। সে কাজ করছে টুকটাক। আমি ওকে নিয়ে অনেক কিছুই করতে পারি। কিন্তু করিনা কারণ আমি ওকে স্বাভাবিকভাবে রাখার চেষ্টা করি। ও যাতে নিজেকে কখনই না ভাবে ‘আই এম নট নরমাল’।
মো. গোলাম মোস্তাফা বলেন, ‘আমি পড়াশোনা করেছি বিদেশে। ছেলে হয়েও আমি সেলাই কাজ পারি, পাপোশ বানাতে পারি, জায়নামাজ বানাতে পারি। আমি স্ত্রীর পোষাক বানিয়ে দিই। আমি রান্নাবান্না পারি। এ সবকিছুর পেছনে অবদান আমার মায়ের। মহুয়ার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। মা খুব ভালভাবে জানেন কীভাবে একটা শিশুকে মানুষ করে তুলতে হয়।’
এসএস