পিরিয়ড ছুটির আগে ট্যাবু ভাঙ্গুক—বলছেন ঢাকার নারীরা
ঢাকার একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সফটওয়্যার প্রোগ্রামার উম্মে রুম্মান ঊষা ঘুম থেকে উঠেই তলপেটে প্রচণ্ড অথচ চিরপরিচিত ব্যথা অনুভব করেন। অসহ্য ব্যথায় সকালবেলা বিছানায় কাটালেও অবশেষে ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থতার ভান করে অফিসের পথে রওনা হন তিনি।
পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব এখনও সমাজে একটি অনুচ্চারিত শব্দ। বিভিন্ন দেশে পিরিয়ডকালীন ঐচ্ছিক ছুটির ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে এখনও পিরিয়ড একটি ট্যাবু। এমন একটি সমাজে থেকে পিরিয়ডের সময় নারীরা কর্মক্ষেত্রে ছুটি পেতে পারেন কী না তা নিয়ে আমরা ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরের শিক্ষার্থী, কর্মজীবী নারী ও বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলেছি। বেশিরভাগ নারীরা বলেছেন পিরিয়ড একটি ট্যাবু। এ সময় তারা শারীরিক কষ্ট বা অস্বস্তিতে ভুগলেও সেটি জানানোর মত পরিবেশও নেই। ছুটি চাওয়া এখনও অসম্ভবের মতোই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবী নারী রয়েছেন বাংলাদেশে।

ঢাকায় বাসাবাড়িতে কয়েকজন গৃহকর্মী নারীকে প্রশ্ন করতেই তারা বলেন, ‘অফিসে মাসিকের জন্য ছুটি দিলে, ওই অফিসের সবাই জানবে যে, মহিলাদের মাসিক কখন শুরু হইছে। এগুলা তো লজ্জার ব্যাপার। বেয়াদবি। আমাদের দেশে এগুলা চলতো না।’
‘মেয়েদের চাকরিতে নেওয়া লস প্রজেক্ট’
কর্মপরিবেশ এখনও নারীবান্ধব হয়নি জানিয়ে ঢাকার বেশিরভাগ কর্মজীবী নারীরা বলেছেন—নারীকে এখনও শারীরিকভাবে দুর্বল এমন ঘোষণা দিয়ে কাজে নেওয়া হয় না। অনেক অফিসে পিরিয়ড হয়েছে এ কথাটি বলার পরিবেশও নেই। সেখানে ছুটি আশা করা করা যায় না।
এ বিষয়ে সফটওয়্যার প্রোগ্রামার উম্মে রুম্মান ঊষা বলেন, ‘নারীর মাতৃত্ব যতটা মহান এ দেশে ততটাই অবহেলিত নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের যত্ন। ঋতুকালীন ছুটির কথা ভাবিওনি কখনও কারণ শারীরিকভাবে দুর্বল কাজের উপযোগী নয় বলে জানিয়ে কত কাজের সুযোগই দেওয়া হয় না নারীদের। শারীরিক দুর্বলতার দোহাই দিয়ে এখনও বিভিন্ন কাজে নিয়োগ দেওয়া হয় না। মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতেই তাদের কত বাঁকা হাসি। অনেকের কাছেই শুনি ‘মেয়েদের চাকরিতে নেওয়া লস প্রজেক্ট’।

উম্মে রুম্মান বলেন, ‘সমাজে এখনও প্রতিষ্ঠিত যে মাঠঘাটের কাজ কেবল পুরুষের। কর্মজীবী নারীরা এখনও উহ্য। এ সমাজের কাছে আশা অনেক কম। সমাজ আমাদের মেয়েমানুষ না ভেবে মানুষ হিসেবে নিক সেটাতেই আমি খুশি। মাসিকের যন্ত্রণা না হয় ব্যাথার ওষুধ খেয়ে হট ওয়াটার ব্যাগের সেঁক দিয়ে সয়ে নেব।
ঢাকায় অবস্থিত স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা রিফাত আরা (ছদ্মনাম) বলেছেন, ‘আমি আগে এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি যেখানে, প্রচণ্ড শরীর খারাপ থাকা সত্ত্বেও সুপারভাইজারকে পিরিয়ডের কথা জানানোরও পরিবেশ ছিল না, এতটাই পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশ।
রিফাত আরা বলেন, তবে এখন যেখানে কাজ করছি, সেখানে আমাদের কিছুদিন পরপরই বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দেওয়া হয়, ডাইভার্সিটি ট্রেনিং, ওয়ার্ক প্লেসে বিহেভিয়ারেল কনডাক্টের ট্রেনিং। নারী ও পুরুষ সহকর্মী উভয়ই অংশগ্রহণ করছেন। এখানে আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্যে জানাতে পারি যে আমার পিরিয়ড হয়েছে, সুস্থ লাগছে না, আমি আজ ছুটি নেব।
‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে একটি সিক রুম রয়েছে, গরম পানির ব্যাগের ব্যবস্থা রয়েছে। পিরিয়ডের সময় সিক রুমে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে, বা নিজের আরাম করে বসে কাজ করা যায়। আবার, বাসা থেকে অফিস করার সুযোগ ও রয়েছে আমাদের’—যোগ করেন রিফাত আরা।
পিরিয়ড ছুটির বিষয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখনই পিরিয়ডকালীন ছুটির ব্যাপারে আলোচনা করতে প্রস্তুত নয়। দেশের সরকারি বেসরকারি অফিসের কাজের পরিবেশ ভিন্ন। ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে পারি আমরা। পুরুষ কলিগদের পক্ষ থেকে তাদের নারী কলিগদের প্রতি মানসিক সাপোর্টের চর্চাটা শুরু হোক আগে।
পিরিয়ডের সময়ের ছুটি যদি থাকেও তবুও সেটাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য একে অপরের প্রতি সহযোগী হতে হবে। তা না হলে সব কাগজের আইন হয়ে থাকবে। কর্মক্ষেত্রগুলোতে বেশি বেশি ট্রেনিং ও মানবিকতার চর্চা হোক। তবে ছুটির ব্যাপারটাও আলোচনায় আসবে।
পিরিয়ডে কেমন থাকে নারী শরীর?
নোয়াখালীর জেলার চর আলগী ইউনিয়ন হাসপাতালের ডাক্তার আনোয়ার আজম বলেন, ‘পিরিয়ডের সময় আমাদের শারীরিক মানসিক সব ধরনের পরিবর্তন হয়। শারীরিক যে সমস্যাটা অনেকের হয় তা হল, ‘অতিরিক্ত রক্তপাত’ বা ‘ডিজম্যানোরিয়া’। এটির কারণে অনেক নারীরই দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজ করতে কষ্ট হয় । এছাড়া তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন বেশিরভাগ নারী। এভাবে আসলে কাজে মনোযোগ দেওয়া যায় না।
ডাক্তার আনোয়ার আজম বলেন, পিরিয়ডের ব্যথাকেই কেবল আলোচনায় আনা হয়, কিন্তু আমি মনে করি, ব্যথার চেয়ে শারীরিক অস্বস্তি এবং হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে মানসিক যেই অস্বস্তি শুরু হয়, সেটি অধিক পীড়ার। পিরিয়ডের সময় তাদের এস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোন দুটোতে অসামাঞ্জস্যতা দেখা দেয়। ফলে নারীদের খুব সহজে বিরক্ত হতে বা ইমোশনাল হতে দেখা যায়। এ সময় তাদের পরিবারের মানুষ বা কাছের মানুষের আন্তরিকতার প্রয়োজন হয়।

আনোয়ার আজম বলেন, বিশেষভাবে বলতে হয় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার অসুবিধার কথা। অনেক নারীর কর্মক্ষেত্রে পিরিয়ডের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা রাখা বা গরম পানির বোতলের ব্যবস্থা রাখা হয়না। পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা এসময় খুবই জরুরি এবং বাসায় সেটি ভালোভাবে মেনটেইন করা যায়। পিরিয়ডের প্রথম ১-২ দিন অন্তত ছুটি দেওয়া হলে ঘরে থেকে, নিজের কমফোর্ট জোনের ভেতরে থেকে একটু হলেও ভালো অনুভব করা যায়।’
ব্র্যাক জেমসপি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাব্লিক হেলথ এ কর্মরত রিসার্চার ইমতিয়াজ নাদভী এ প্রসঙ্গে উইম্যানভয়েসবিডিকে বলেন, ‘বাইরের দেশগুলোতে যদিও এইরকম ছুটির ব্যবস্থা আছে, পরিসংখ্যান আমাদের বলে যে, শতকরা ১১% ইউরোপিয়ান নারী ও এই সুবিধাটি ভোগ করেননি। আসলে পিরিয়ডের জন্য আলাদা ছুটির কথা না বলে সিক লিভের মাধ্যমেই ছুটি নেওয়া যায়।
ইমতিয়াজ নাদভীর মতে, ‘বেশি জরুরি হলো, কর্মক্ষেত্রে নারীদের পিরিয়ডের সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বা হাইজিন মেনটেইন। যেমন, স্যানিটারি প্যাডের উপর ট্যাক্স কমানো, কর্মক্ষেত্রে নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে ফ্রি অ্যক্সেস।
ট্যাবু ভাঙ্গুক আগে
পিরিয়ড ছুটির প্রশ্নে বেশিরভাগ নারীরা মত দিয়েছেন আগে এ নিয়ে কথা বলা যাবে না এমন ট্যাবু ভাঙ্গুক। অফিসটা নারীবান্ধব হোক। পিরিয়ডে শরীর খারাপ লাগলে কথাটি বলার মত পরিবেশ তৈরি হোক। তারপরে হয়ত ছুটি দেওয়া যায় কী না এ নিয়ে আলোচনা করা যায়। তার আগে নয়। সফটওয়্যার প্রোগ্রামার উম্মে রুম্মান ঊষা বলেছেন, অনেক অফিসে অসুস্থ লাগছে বিষয়টাই চেপে যেতে হয়। কারণ নারীকে নানাভাবে শারীরিকভাবে অক্ষম ঘোষণা দেওয়া হয়।
ছুটির প্রশ্নে ইমতিয়াজ নাদভী বলেন, ‘এ ছুটির ব্যাপারটি কেবলই সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশের নারীর জন্য নিশ্চিত করা সম্ভব। যিনি ইটের ভাঁটায় কাজ করেন, তাকে কেউ পিরিয়ডের জন্য ছুটি দিবে না। ফলে, আমি বলতে চাই, ছোটবেলা থেকে পিরিয়ড নিয়ে যেই সামাজিক ট্যাবুটা আছে, তা যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বা বাসায় বাচ্চাদের সাথে আলাপ করে, এই ট্যাবু ভাঙা যায়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের মাসের এই তিন দিন এতটা ভোগান্তি পোহাতে হবে না।’
পিরিয়ডে ছুটি উচিত বলেছেন যারা
আমাদের প্রশ্নোত্তর প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া একটি অংশ বলেছেন, পিরিয়ড লিভ নিয়ে আলোচনার সময় এখনই। শ্রমে অংশ নেওয়া লক্ষাধিক নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শামসুল আরিফ ফাহিম বলেন,‘পিরিয়ডের সময় ছুটি দেওয়াটা উচিত মনে করি। এ সময়ে নারী স্বাস্থ্যের অবস্থা ঝুঁকিতে থাকে। নারী ওই সময়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পেলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের তো অবনতি হয় পাশাপাশি তার কাজের প্রোডাক্টিভিটিও কমে যায়।’
ঢাকার একটি কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার মিশু বলেন, ‘মেয়েদের পিরিয়ডকে যখন আমরা শরীরের স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতে শিখবো তখনই বাকি সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তখন ছুটি নিয়েও মেয়েদেরকে অফিস বস বা সহকর্মীদের বাঁকা চোখে তাকানোর শিকার হতে হবে না আর ছুটি না নিয়ে ও পেট ব্যথা চেপে অফিসে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করতে হবে না।’