‘আমিতো অ্যাথলেট ছিলাম। ২০০ মিটার দৌড়, লংজাম্প, চাকতি নিক্ষেপসহ আরও অনেক কিছু জেলা পর্যায়ে খেলেছি। তার পরতো যা হয়। ঘর সংসার মিলিয়ে হয়ে ওঠেনি।’—খিমার পরে ছেলের সাথে ক্রিকেট খেলে হঠাৎ আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসা মিস ঝর্ণা আক্তার চিনির বক্তব্য।
আলোচিত নারীর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র রাগ, ক্ষোভ, উষ্মা নেই। বরং ছেলের সাথে কাটানো ফ্রেমবন্দি ওই সময়টুকুর উচ্ছ্বাস আমাকেও ছুঁয়ে গেছে। অত্যন্ত সুন্দর মুহূর্ত।
আমি বা আমরা অনেকেই যে সমালোচনাগুলো করলাম গত কয়েকদিন তাঁর পেছনে ওই নারীকে ব্যক্তিগতভাবে হেয় করা উদ্দেশ্য ছিলো না। আমরা বলতে চেয়েছি একসময়ের একজন অ্যাথলেট নারীর আজকের বোরকা, হিজাব, খিমারে আবৃত হওয়ার পেছনে কতগুলো ষড়যন্ত্র আছে। এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পারার জন্য যে মানসকাঠামো দরকার হয় সেটা না থাকলে আমাদের এইসব কথাবার্তা নারীবাদী বা বামপন্থীদের ঘৃণার উদগীরন বলে সাব্যস্ত হবে।
একজন মানুষ বিকিনি, শর্টস পরতে পারবে কী পারবে না – এটা বলে দেওয়ার অথোরিটি যেমন আমি, আপনি, মোল্লাতন্ত্র ও রাষ্ট্র নই, তেমনি একজন নারী বোরকা/হিজাব/নেকাব/খিমার পরবে কী পরবে না সেটা বলে দেওয়ারও অথোরিটি আমরা কেউ নই। এটাই আসলে ” Freedom of Choice”। মানুষের LIBERTY ‘র প্রতি যদি আমাদের শ্রদ্ধা থাকে তাহলে এটাকে মেনে নিতেই হবে।
সমস্যাটা তাহলে কোথায়? যে সমাজে বিকিনি, শর্টস পরা ‘স্বাভাবিক’ সেখানে কিন্তু কোন অথোরিটি বলছে না যে, তুমি বিকিনি পরতে পারবে না কিংবা হিজাব/বোরকা পরতে পারবে না (দু’একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া)। কিন্তু আমাদের মত দেশে যেখানে মাথায় ঘোমটা বা বুকে ওড়না না থাকলে কেবল পরিবারের লোকজন নয়, লোকাল বাসের কন্ট্রাকটার থেকে শুরু করে রিক্সাওয়ালা, লিফটের দারোয়ান, অফিসের বস মোটামোটি সকল শ্রেণি পেশার মানুষ মোরাল পুলিশিং শুরু করে দেয় সেখানে ”বিকিনি ইজ মাই চয়েসের” কোনও বেইল আছে কি?
এই প্রসঙ্গে মোল্লাতন্ত্রের বক্তব্য বেশ আগ্রহ জাগানিয়া। পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা বা রমনার বটমূলের গানবাজনাকে ওনারা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ বলতে নারাজ হলেও বোরকা/হিজাব/নেকাব/খিমারকে সংস্কৃতির অংশ ভাবতে পছন্দ করেন। আবার অধুনা কেউ কেউ এগুলোকে সংস্কৃতির অংশ করতে উৎসাহী। যদিও বোরকা/হিজাব/খিমার এ অঞ্চলের মানুষের পোশাক সংস্কৃতির উপাদান ছিলো কী না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এগুলোর পেছনের রাজনীতিটা ছিলো আসলে বাঙালি সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে মুসলমান আইডেন্টিটিকে প্রধান করার চক্রান্ত। ওই চক্রান্ত দীর্ঘদিনের। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ, রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুর কবি সাব্যস্ত করে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীর উৎসব করতে বাধা দেওয়া কিংবা বর্তমানে হেফাজতের প্রেসক্রিপশন মেনে ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া এ সবই তথাকথিত ইসলামি আইডেন্টিটির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত।
এই চক্রান্তের প্রধান শিকার নারী। সেকারণেই বলতে চেয়েছি এই ধরনের পোশাক নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া পিতৃতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের অংশ। এই ষড়যন্ত্র অন্তত তিনভাবে কার্যকর আছে —
এক, এই জাতীয় পোশাক পরতে সরাসরি বাধ্য করা।
দুই, ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সামাজিক চাপের কারণে বাধ্য হওয়া।
তিন, ইহজাগতিক ও পারলৌকিক লোভের ফাঁদে ফেলে মনস্তত্ব পরিবর্তন করে দেওয়া।
এতে মনে হবে কোনো প্রকার চাপ ছাড়াই সে ওই পোশাকগুলো পরছে। যেমন খাঁচায় বেড়ে ওঠা পাখিকে একসময় ছেড়ে দিলেও সে আবার ফিরে আসে। খাঁচাটাকেই তার ‘বিশাল পৃথিবী’ মনে হয়। তেমনি একসময় চৈত্রের তীব্র দাবদাহের ভেতরেও বোরকা/খিমার ছুঁড়ে ফেলে দিতে মন সায় দেয় না। পুরো ব্যাপারটাই তখন সাইকোলজিক্যাল ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। এটা আদতে চয়েস নয়।
একটা জিনিস চয়েস হতে হলে অবশ্যই ফেয়ার প্লে গ্রাউন্ড থাকতে হয়। যেমন— নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি ওয়েলফেয়ার স্টেটের কথা বলা যায়। যেখানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরে কিছু প্রিন্সিপল তারা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, যার ফলে পলিসি ও স্ট্রাটেজির অংশ হিসেবে এসব দেশে ইকুয়ালিটি আছে, ন্যায়বিচার আছে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে, জেণ্ডারভিত্তিক সাম্য আছে, ধর্মকে যেখানে রাষ্ট্র থেকে বিযুক্ত করা হয়েছে। এইসব গ্রাউন্ড তৈরি করার আগে বোরকা/হিজাব ইজ মাই চয়েস বলা কিংবা বোরকা হিজাবকে সংস্কৃতির অংশ করতে চাওয়া পশ্চাৎপদ ও আত্মঘাতী।
‘খিমার/হিজাব ইজ মাই চয়েস’ বলার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন ‘বিকিনি/শর্টস ইজ হার/হিজ চয়েস’ মানতে প্রস্তুত আছেন কি না?
লেখক: আইনজীবী (সুপ্রিম কোর্ট) ও মানবাধিকার কর্মী