বিনোদন শিল্প মানে অনেকটাই পুরুষের আধিপত্য। পুরুষই মূল চালক এ গল্প একটি কেবল এ দেশের নয় সারাবিশ্বের। একথা অস্বীকার করা সুযোগ নেই। হলিউডের সিনেমায় যৌনতা পেয়েছে অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। ফলে বিনোদন শিল্প ও যৌনতা সমান্তরাল হয়ে উঠেছে। মিশ্র এমন সংস্কৃতির মধ্যে পুরুষের যৌন আক্রমণের শিকার হয়ে অনেক নারীই সরব হয়েছেন। এছাড়াও বর্ণবাদ, বয়সবাদ, ও লিঙ্গ সমতার লড়াইয়ে জনপ্রিয় অনেক অভিনেত্রীরা গর্বভরে নারীবাদীর পতাকা উড়িয়েছেন। করেছেন সাহসী মন্তব্যও।
এমন কয়েকজন সাহসী মার্কিন অভিনেত্রী ও টেলিভিশন সেলিব্রেটিরা হলেন
১.অ্যাশলে জুড
হলিউড অভিনেত্রী অ্যাশলে জুড যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন হলিউড সিনেমার এক ক্ষমতাধর স্টুডিও এক্সিকিউটিভ হার্ভে ওয়েস্টাইনের বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে মামলা দায়েরের পর সে খবর নিয়মিত প্রচারিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় পত্রিকা নিউইয়রক টাইমসে। অ্যাশলের তোলা অভিযোগ থেকে উঠে আসে হার্ভে ওয়েস্টাইন আরও নারীদের সাথে একই কাজ করেছিলেন। অ্যাশলেসহ আরও ৫০জন নারী মামলা দায়ের করেছিলেন হার্ভে ওয়েস্টাইনের বিরুদ্ধে।
এর আগেও পুরুষতন্ত্র ও নারীবিদ্বেষী লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাহসী মন্তব্য করেন হলিউড অভিনেত্রী অ্যাশলে জুড। তিনি পুরুষতন্ত্রের নানা নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করেছেন তার কথায় ও লেখায়। অ্যাশলে ওয়াশিংটনে নারীবাদীদের সম্মিলিত আন্দোলনের মার্চ এ অংশ নেন।
নারীবাদী কবিতা ন্যাস্টি উইম্যান বা নষ্ট নারী শিরোনামে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত কয়েক হাজার নারী প্রতিবাদকারীদের সাথে রোড মার্চে অংশ নিয়েছিলেন ২০১৭ সালে।
২.জেসিকা চ্যাস্টেইন
তিনি বিখ্যাত হলিউডের নারীবাদী থিমে তৈরি সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। টাইম ম্যাগাজিন যাকে ২০১২ সালে একশো ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। চ্যাস্টেইন হলিউডের প্রযোজনা সংস্থা ফ্রাকল ফিল্মসের প্রতিষ্ঠাতা।
অভিনেত্রী বা প্রযোজক জেসিকা চ্যাস্টেইন নন ব্যক্তি জেসিকা চ্যাস্টেইনও নিজের সাহসী মন্তব্য নিয়ে উড়িয়েছেন নারীবাদের পতাকা। কিন্তু তিনি ২০১৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে সবচেয়ে সাহসী মন্তব্যটি করেন, তিনি একটি প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে যদি আপনার কাছে নারীর গল্প বলার থাকে তবে আপনার মধ্যে সুস্পষ্ট একটি নারী চরিত্র রয়েছে। “আমি সত্যিই কানের কাছ থেকে সমস্ত চলচ্চিত্র সরিয়ে নিয়েছি। কারণ নারী চরিত্রগুলোকে আমি প্রতিনিধিত্ব করতে দেখেছি। আমি জেনেছি বিশ্ব নারীদেরকে কীভাবে দেখে। সত্যি কথা বলতে এটা আমার কাছে বেশ বিরক্তিকর ছিল।
৩.বিয়ন্সি
বিয়ন্সি একজন আমেরিকান গায়িকা, গীতিকার এবং অভিনেত্রী। টেক্সাসের হিউস্টনে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, বেয়ন্সি ১৯৯০—এর দশকের শেষের দিকে ডেসটিনি’স চাইল্ডের প্রধান গায়িকা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যা সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া গানের মধ্যে একটি।
বিয়ন্সির গান তার ডেসটিনি’স চাইল্ড ডে বা স্বাধীন নারী কেউ আছে? গানটি তার নারীবাদ ঝোঁকের দিকে ইঙ্গিত করে। তবে কুইন বে সত্যিকার অর্থে একজন নারীবাদী গান হিসেবে চিহ্নিত কিনা তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকলে দেখুন ২০১৪ সালের ভিএমএ তে পারফরম্যান্সের দৃশ্যটি। সেখানে অন্ধকার মঞ্চের দেয়ালে জ্বলজ্বল করছিল ফেমিনিস্ট শব্দটি।
৪.গিনা ডেভিস
ভার্জিনিয়া এলিজাবেথ ডেভিস একজন আমেরিকান অভিনেত্রী প্রযোজক এবং মডেল। ব্রিটিশ একাডেমি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড এবং প্রাইমটাইম এমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও একাডেমি পুরস্কার এবং গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার উঠেছিল তার হাতে। তিনি হলিউডে এবং পর্দার বাইরে লিঙ্গ বৈষম্যর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কাজ করেছেন কয়েক দশক ধরে। এ কাজের জন্য ২০১৯ সালে জিন হার্শোল্ট মানবিক পুরস্কারেও ভূষিত হন গিনা ডেভিস।
মিডিয়ায় নারীর অধিকার, রেসিজমের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে তিনি এখন এজিসমের মানে হলিউডের টু ওল্ড টু প্লে নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেছেন নারী অভিনেত্রীরা ৫০ পেরুলে সিনেমায় কাস্টিং পাওয়া দুরুহ হয়ে পড়ে। যা কী না নারীর বিরুদ্ধে লিঙ্গ রাজনীতি। তিনি চান পর্দায় ঘন ঘন নারীর উপস্থিতি।
৫.প্যাট্রিসিয়া আর্কুয়েট
প্যাট্রিসিয়া টিফানি আর্কুয়েট আমেরিকান অভিনেত্রী। তিনি একটি একাডেমি পুরস্কার, ব্রিটিশ একাডেমি চলচ্চিত্র পুরস্কার, দুটো প্রাইমটাইম এমি পুরস্কার, তিনটি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার এবং দুটি স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কারসহ অসংখ্য প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
তিনি ২০১৫ সালের অস্কার পুরস্কারে জিতেছিলেন সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরস্কার। সেখানে তিনি নিজের বক্তব্যে হলিউডে নারী পুরুষের মজুরি বৈষম্যের কথা তুলে ধরেছিলেন।
৬.ক্রিস্টেন বেল
ক্রিস্টেন বেল টুইট করে বলেছিলেন নারী-পুরুষের সমান মজুরি কোন রসিকতা নয়। পিঙ্কসোর্সিং-এ খরচ কমাতে চায় এমন ব্যবসার জন্য ক্রিস্টেন বেল শালীন প্রস্তাবে একটি শর্ট ফিল্ম তৈরি করেন যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে মজুরি ব্যবধানকে ব্যঙ্গ করেছে।
তিনি বলেন সস্তায় তো মার্কিন নারীদের কাজে পাওয়া যায় তবে কেন অযথা শ্রম আউটসোর্সিং করতে ভারত চীন বা নার্নিয়া যেতে হবে। এ কথায় তিনি সুক্ষ্মভাবে মার্কিন নারীদের মজুরি বৈষম্যের কথা উল্লেখ করেছেন।
শর্ট ফিল্মটি দেখুন
৭.লেনা ডুনহাম
ডানহাম হলিউডে এক দশকেরও কম সময় ধরে আছেন। তিনি বারবার নিজেকে একজন নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন ও নিজের দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করেছেন।
তার তৈরি ভিডিও, প্রবন্ধ, বই, টুইট কিংবা নিষিদ্ধ এইচবিও সিরিজ যা তিনি তৈরি করেছেন, লিখেছেন, প্রযোজনা করেছেন, পরিচালনা করেছেন। তিনি তারকাদের মাধ্যমে নারীর অধিকার নিয়ে প্রায়ই কথা বলেন। তিনি বর্তমানে ষাটের দশকের দ্বিতীয়-তরঙ্গের নারীবাদ নিয়ে একটি সিরিজের কাজ শুরু করেছেন।
৮.শোন্ডা রাইমস
শোন্ডা লিন রাইমস একজন আমেরিকান টেলিভিশন প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার এবং লেখক। তিনি টেলিভিশন মেডিকেল ড্রামা গ্রে’স অ্যানাটমির প্রধান লেখক। রাইমস কাজ করেছেন এবিসি টেলিভিশনের সিরিজ অফ দ্য ম্যাপ, হাউ টু গেট অ্যাওয়ে উইথ মার্ডার, দ্য ক্যাচ এবং গ্রে’স স্পিন-অফ স্টেশন সিরিজে।
তিনি বরাবরেই প্রেসকে শক্তিশালী নারীবাদী বিশ্বাস সম্পর্কে বলেছেন। ক্ষমতা, বাধ্য এবং সততার বিপরীতের চরিত্র তৈরি করছেন শোন্ডা। ২০১৫ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘একজন নারীবাদী হওয়ার সৌন্দর্য হল যে আপনি যা চান তাই হতে পারেন, এবং এটাই আসলে মূল বিষয়।’
৯.এমা ওয়াটসন
এমা ওয়াটসনের কথায় নারীবাদ সম্পর্কে আপনাকে বোঝানোর জন্য বলব লিঙ্গ সমতায় আপনার জন্য কিছু থাকবে, আপনার বোন বা আপনার মায়ের জন্যও কিছু আছে এবং মানুষের জন্যও এটি শান্তির ও সুখের। একটি বিয়ে একটি সত্যিকারের অংশীদারিত্ব সেটি বুঝবেন যদি লিঙ্গ সমতার দাবিকে বুঝতে চেষ্টা করেন। পৃথিবী নামক গ্রহে নিরাপদ, আত্মবিশ্বাসী এবং পরিপূর্ণ মানুষ নারীও। তাদের ফেলে রেখে বিশ্বে শান্তি আসবে না।
খুব অল্প বয়স থেকে হলিউড অভিনেত্রী এমা ওয়াটসন বাস্তবিকপক্ষে একজন নারীবাদী আইকনে পরিণত হয়েছেন। তিনি হ্যারি পটার চলচ্চিত্রে অনুপ্রেরণাদায়ী হারমায়োনি গ্রেঞ্জার হিসাবে অভিনয় করেছিলেন।
১০.অ্যামি শুমার
অ্যামি বেথ শুমার হলেন আমেরিকান স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান এবং অভিনেত্রী। ২০০৭ সালে এনবিসি রিয়েলিটি প্রতিযোগিতা সিরিজ লাস্ট কমিক স্ট্যান্ডিং-এর পঞ্চম সিজনে একজন প্রতিযোগী হিসাবে উপস্থিত হওয়ার পর তিনি ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তিনি এর নির্মাতা, সহ-প্রযোজক, সহ-লেখক এবং তারকা ছিলেন।
তার জনপ্রিয় স্কেচ কমেডি সিরিজ ইনসাইড অ্যামি শুমারে ট্রেনওয়েক ও স্ট্যান্ড আপ সেটের কমেডি পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে রসিকতায় কামড়ে ছিন্ন করেছে। কমেডিতে দেখিয়েছেন ধর্ষণের সংস্কৃতি, লিঙ্গ অসমতা, হলিউডের যৌনআচরণ। ২০১৫ সালে একটি লাইভ কমেডি শোতেতিনি বলেছিলেন, মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে বলে, ‘অ্যামি, হলিউডে এটা কী নারীর জন্য উত্তেজনাপূর্ণ সময়?’ এবং অ্যামি বলেন ‘না’।
১১.জেনিফার লরেন্স
জেনিফার শ্রডার লরেন্স একজন আমেরিকান অভিনেত্রী। এখন পর্যন্ত তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো বিশ্বব্যাপী ৬ বিলিয়ন আয় করেছে। তিনি ২০১৩ সালে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ফোর্বসের ১০০ সেলিব্রিটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
লরেন্স ডেভিড ও. রাসেল চলচ্চিত্রে ব্র্যাডলি কুপার, ক্রিশ্চিয়ান বেল এবং জেরেমি রেনারের চেয়ে কম অর্থ উপার্জন করেছেন যদিও তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন।
লিঙ্গ বেতনের বৈষম্য সম্পর্কে লরেন্স একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তাতে তিনি বলেন, ইকোনমিক পলিসি ইনস্টিটিউটের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে নারীদের ঘণ্টায় মজুরি পুরুষদের ঘণ্টার মজুরির মাত্র ৮৩ শতাংশ।
লরেন্স হলিউডের সমস্যাগুলির বিরুদ্ধে কথা বলা অভিনেত্রীদের সাথে যোগ দেন। একটি কোরাসে তিনি কণ্ঠ দেন যেখানে এমা ওয়াটসন, মেরিল স্ট্রিপ, গিনা ডেভিস, কেট ব্ল্যানচেট, প্যাট্রিসিয়া আর্কুয়েট এবং ডানহাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।