‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ পরীক্ষার ফরম ফিলআপ করার টাকা নেই। পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১ মাস আগে শুরু করলাম টিউশন। ওই টিউশনি থেকে এক মাসের অগ্রিম নিয়ে ফরম ফিলআপ করি। আমার বান্ধবীরা অনেক সময় আমাকে ফোন দিত আমি কি পড়ছি সেটা জানার জন্য। আমি তখন টিউশনিতে থাকতাম। টিউশনিতে গিয়ে অপেক্ষা করতাম নাশতা কি দেয় তার জন্য। ওইটাই আমার সারাদিনে খাওয়া একমাত্র খাবার ছিল। রাতে ফিরে বাসায় খেতাম। এখন আমার বাসা ভাড়াই প্রতিমাসে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। আমার মাসিক হাত খরচও ১ লাখেরও বেশি। আমার গবেষণা প্রজেক্টের ফান্ড কোটি টাকার চেয়ে বেশি। আমি কখনো প্রিন্সেস ছিলাম না। আমি সবসময়ই কিং অফ মাই ওন কিংডম। ’ —এ গল্প একজন সফল নারীর। তিনি ক্যারিয়ার ও শিক্ষায় সাফল্যের অসাধারণ ক্যারিশমা দেখিয়েছেন। জীবনে বিভিন্ন সমস্যা থাকলেও মানুষ চাইলে সবকিছুই করতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। ‘মেয়েরা পারে না’ কথাটিকে একেবারেই অচল বলতে চান তিনি।
তিনি হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোনম আকতার। তাঁর জন্ম চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ছমদর পাড়া গ্রামে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সাতকানিয়াতেই। চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগে। সেখান থেকে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স ও মাস্টার্স শেষের পর শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েই। ৩ বছর শিক্ষকতার পর জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে নিউরোসায়েন্স বিষয়ে গবেষণা করতে যান জাপানের বিখ্যাত রিকেন সেন্টার ফর ব্রেইন সায়েন্স ইনস্টিটিউটে। ওখানে প্রায় দেড় বছর কাজ করার পর ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে সেখানেই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে পিএইচডি গবেষণার শেষ বর্ষে আছেন বলে জানান সোনম।
সম্প্রতি নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে শেয়ার করেন তাঁর জীবনের চড়াই উৎরাই ও দারিদ্র্যের সাথে তাঁর যুদ্ধ জয়ের গল্প। উইম্যান ভয়েসের পাঠকের জন্য তা অবিকল তুলে ধরা হল।
আমার জীবনের গল্প
ছোটবেলায় আমরা খুব দরিদ্র ছিলাম। কতদিন এমন গেছে বাসায় খাওয়ার কিছু নেই। মা তখন টমেটো তেলে দিয়ে ভর্তা করে ফেলত। কারণ এটা দিয়ে শুধু শুধু ভাত খেতে গলায় আটকায় না। কখনো কখনো একটা ডিম ভাজা হত। সেই ডিম তিন চার জন ভাগ করে খেতাম। পুরো একটা ডিম খাওয়া কখনো দেখিনি। ছাগল কোরবানি দিতাম। তখন একদম বাচ্চা ছিলাম তখন গরু কোরবানি দেয়া হত। এরপর ওইরকম সামর্থ্য হয়ে উঠেনি। কোন কোন বছর কোরবানি দেয়া হত না। টাকা ছিলনা। চারপাশের সব বাড়ি থেকে গরুর মাংস রান্নার সুগন্ধ ভেসে আসত। আমরা অপেক্ষা করতাম যদি কেউ এসে দিয়ে যায়। মা বেরুতে দিত না। ছোট ছিলাম। কতকিছু বোঝার সময় হয়নি তখন।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। তখন চট্টগ্রাম শহরে বাসা ভাড়া করে থাকি। বাসা ভাড়া দিতে জান যায় অবস্থা। পড়ার টাকা তো অনেক দূরে। দিনে ৩০ টাকা পেতাম। সেই টাকা ইউনিভার্সিটি যাওয়া আসাতেই শেষ হয়ে যেত। দুপুরে লাঞ্চ হিসেবে একটা আলুর চপ বা একটা সিঙ্গাড়া। কত দুপুর না খেয়েও থাকতে হয়েছে। কত রাত না খেয়ে থাকতে হয়েছে। আহ্! পৃথিবীতে যে ক্ষুধার কষ্ট বুঝেনি, সে আসলে ভাগ্যবান।
প্রথম বর্ষ পরীক্ষার ফরম ফিলআপ করার টাকা নেই। পরীক্ষা শুরু হওয়ার এক মাস আগে শুরু করলাম টিউশন। ওই টিউশনি থেকে এক মাসের অগ্রিম নিয়ে ফরম ফিলআপ করি। আমার বান্ধবীরা অনেক সময় আমাকে ফোন দিত আমি কি পড়ছি জানার জন্য। আমি তখন টিউশনিতে। টিউশনিতে গিয়ে অপেক্ষা করতাম নাশতা কি দেয় তার জন্য। ওইটাই আমার সারাদিনে খাওয়া একমাত্র খাবার ছিল।
তিনটা টিউশনি শেষ করে বাসায় আসতে আসতে বাজত রাত এগারোটা। এরপর খেয়ে পড়তে বসা। সন্ধ্যা থেকে পড়তে বসবো সেই বিলাসিতা করার কোন সুযোগ আমার ছিল না। তখন দরিদ্রতাকে খুব ছোট মনে হতো। নিজেকে ছোট লাগতো। আমার বান্ধবীদের অনেকে আমি যে এত দরিদ্র সেটা হয়তো তখন জানতো না। আমার বান্ধবী স্বর্ণা আমাকে এক জোড়া সিলভার কালারের কানের দুল গিফট করেছিল আমি কান ফোঁড়ানোর পর। অনেক দিন পর্যন্ত ওই কানের দুল আমার একমাত্র কানের দুল ছিল। বছরের পর বছর ঈদের জামা কিনতে পারিনি। কোন বিয়েতে মেতে হলে স্বর্ণা, নাবিলা বা তারিনের কাছ থেকে শাড়ি নিতাম। কারণ প্রোগ্রামে পরার মত কাপড় ছিলনা। এই মেয়েগুলো এত করেছে আমার জন্য মাশাআল্লাহ। আমি আমার সব বান্ধবীর বাসায় গিয়েছি, আমার বাসায় আমি কখনো দাওয়াত দিতে পারিনি। লজ্জা লাগতো। বাসায় সোফা নাই। ডাইনিং টেবিল নাই। কি খাওয়াবো। এসব ভেবে তখন লজ্জা লাগতো।
ওই পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়, আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে আর মা বাবার দোয়ায় আজ আমি এখানে। এখন আমি যেখানে থাকি আমার বাসা ভাড়াই প্রতিমাসে এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা। আমার মাসিক হাত খরচ এক লাখ টাকার চেয়ে বেশি। আমার গবেষণা প্রজেক্টের ফান্ড কোটি টাকার চেয়ে বেশি। এবং এই সম্পূর্ণ টাকা ডেনিশ সরকার আমাকে দিচ্ছে। আমার পড়ালেখার জন্য। এর আগে জাপান সরকার দিয়েছে তাও আমার পড়ালেখার জন্য। এখন আমি এখানে তার কারণ আমি এক সময় অসম্ভব সংগ্রাম করেছি। আমি যখন কাউকে বলি যে একাগ্রতা, পরিশ্রম এবং জেদ সব বদলাতে পারে তখন আমাকে অনেকেই বলে “আপনি এগুলা বুঝবেন না। জীবন অনেক কঠিন।” এবং আমি যখন উত্তর দিই আমি বলি জানি, আমি এই সময় পার করেছি। বেশিরভাগই বিশ্বাস করে না। এখনকার আমাকে দেখে এক সময় আমি যে ২ টাকার জন্য দুপুরে লাঞ্চ করতে পারিনি সেটা বিশ্বাস হওয়ার কথা ও না। আমি জানি বলেই আমি বলি— পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নাই। কিন্তু যেটা থাকতে হবে সেটা হচ্ছে ব্যক্তিত্ব, এমন অ্যাবিলিটি যেন কেউ ছোট করে কথা বলতে না পারে। থাকতে হবে জ্ঞান।
এক সময় আমাদের একটা ডিম চারজনে ভাগ করে খেতে হয়েছে। আর আমি এখন চাইলে দিনে কয়টা করে ডিম খেতে পারি। এখন আমি চাইলে বিশ্বের সবচেয়ে দামি রেস্ট্যুরেন্ট সেখানে খেতে পারি। আমি চাইলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের সবচেয়ে দামি জিনিস কিনতে পারি।
আমার কাছে সফলতা মানে শূন্য থেকে সর্বোচ্চ পজিশনে যাওয়া। যাদের অবস্থা ভালো, যারা দিনে তিনবেলা করে খেতে পেয়েছে, প্রতি ঈদে নতুন জামা পেয়েছে, টাকার জন্য কখনো টেনশন করতে হয় নি, তারা ভালো করাটা আমার কাছে স্বাভাবিক। তারা ভালো না করাটাই অস্বাভাবিক। রাজা/রানি থেকে রাজ্য পেলে সেটা স্বাভাবিক বিষয়। শূন্য থেকে রাজ্য সৃষ্টি করাটা আমার কাছে অনেক। আমি কখনো প্রিন্সেস ছিলাম না। আমি সবসময়ই কিং অফ মাই ওন কিংডম। সম্ভবত তাই এখন আমি আমার অতীত নিয়ে অসম্ভব গর্ব অনুভব করি। এখন আমি মনে করি দারিদ্রতা আসলে গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে মানুষ হিসেবে দরিদ্র একজনের অ্যাবিলিটি অনেক বেশি। ওই পজিশনে থেকে বেশিরভাগ মানুষ হয়ত ভাল কিছু করতে পারত না। যে পারে সে পৃথিবীতে সবই পারে।
অনেক অনেক বছর পর এই দিনগুলো মনে করে আবার টমেটো ভর্তা করলাম। সেই মেয়েটির সম্মানে যে একসময় সারাদিন ক্লাস, সারাদিন টিউশনি শেষে বাসায় ফিরে একবেলা খেয়ে আজ পৃথিবীর সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিচ্ছে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার সম্মানে যে সমাজের অনিয়ম, বীভৎস নিয়ম, মেয়েরা পারেনা এই কথা ভুল প্রমাণিত করেছে। যার সামনে এখন “মেয়েরা পারেনা” এই কথা বলার সাহস এবং যোগ্যতা কারো নেই।’