সৎ পিতা তাকে উলঙ্গ করে মাতাল বন্ধুদের মাঝে ছেড়ে দিতেন। ধর্ষণের পর প্রস্রাব করা হত তার মুখের উপর। তার নিজের মা তাকে টাকার জন্য প্লাম্বার বা ইলেকট্রিশিয়ানদের কাছে বিক্রি করত। এসব কিছু শুরু হয়েছিল তার ১১ বছর বয়স থেকে। তিনি লিসা মন্টেগোমারি। যুক্তরাষ্ট্রে ১২ জানুয়ারি লিথ্যাল ইন্জেকশন প্রয়োগ করে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
১১ বছর বয়সে লিসা মন্টেগোমারি তার সৎপিতা জ্যাকের ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। জ্যাক মাতাল থাকতেন ও ঘরে ফিরে লিসা ও তার মাকে মারধর করত।এ ভয়ানক জীবনটি লিসার জন্য স্বাভাবিকে পরিণত হয়েছিল।জ্যাক ঘরের পাশে ঝোঁপে সৎ কন্যাকে ধর্ষণের জন্য ঘর বানিয়েছিলেন, যেখান থেকে লিসার চিৎকার কেউ শুনতে পাবে না।ধর্ষণের সময় বালিশ দিয়ে মুখ চেপে ধরত জ্যাক। একবার প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলেন লিসা মন্টেগোমারি। ওইদিন জ্যাক এতো জোরে তার মাথা ফ্লোরে ধাক্কা দিয়েছিল যে এতে মস্তিষ্কে গুরুতর ক্ষতি হয়েছিলল লিসার। হঠাৎ একদিন, তার মা জুডি ঘরে ঢুকে পড়লেন ও দেখলে তার স্বামীর সাথে তার মেয়ে। লিসার মা জুডি খুব রেগেছিলেন মেয়ের উপর। মেয়ের মাথায় বন্দুক রেখে জুডি বলেছিলেন, তুমি আমার সাথে এটি করতে পারলে?
সময়ের সাথে সাথে সে নির্যাতন বাড়ে। লিসা মন্টগোমারির সৎপিতা তাকে ঘরে গণধর্ষণ করানোর জন্য তার বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। লিসার কয়েক ঘণ্টা ধরে ধর্ষণ চলতে থাকে। ধর্ষণ শেষে তারা শিশু লিসা মন্টেগোমারির মুখে প্রস্রাব করে দেয়। তার মাও একই কাজ করেছিলেন। প্রায়ই টাকার জন্য তিনি লিসার শরীর তুলে দিতেন ইলেকট্রিশিয়ান ও প্লাম্বারদের হাতে।—এ ছিল লিসা মন্টেগোমারির শৈশব।
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, ‘অন্তসত্ত্বা নারী ববি জো স্টিনেটকে হত্যার দায়ে গ্রেপ্তারের পর চিকিত্সক, মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মীরা সকলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এটি দীর্ঘ ট্রমার ফল ও তিনি মানসিকভাবে সুস্থ নন। খুনের আগে তিনি নিজেকে অন্তসত্ত্বা দাবি করতেন। সেই নারী লিসা মন্টেগোমারি এখন ৫২ বছরের পৌঢ়া। ট্রাম্প প্রশাসনের বিচারে তাকে সাত দিনেই সিদ্ধান্ত হল লিসা একজন ঠান্ডা মাথার খুনী। এমনকী তার বাকী জীবন কারাগারে থাকলেও তার শাস্তি পর্যাপ্ত হচ্ছে না। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের একটি আপিল আদালত ফাঁসি কার্যকর করার পথটিও পরিষ্কার করে দেয়। তাদের যুক্তি ছিল লিসার অপরাধ শুধু খুন নয় তিনি নৃশংসতা করেছেন।
ডেথ পেনাল্টি ওয়ার্ল্ডওয়াইড সেন্টারের পরিচালক স্যান্ড্রা বাবকক বলেছেন, ‘লিসা সবচেয়ে খারাপের মধ্যে নয় তিনি ভেঙ্গে পড়াদের মধ্যে সর্বাধিক ভেঙ্গে পড়া এক নারী। লিসার মৃত্যুদণ্ড যদি ১২ জানুয়ারি, টেরে হটের ফেডারেল ডেথ চেম্বারে প্রাণঘাতি ইনজেকশন দিয়ে কার্যকর হয় তবে এটি হবে প্রায় ৭০ বছরের মধ্যে মার্কিন সরকারের মাধ্যমে প্রথম কোন নারীর মৃত্যুদণ্ড।’
২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর তখন মন্টেগোমারি ছিলেন তিনি ৩৬ বছর বয়সী। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাসের নিজের বাড়ি থেকে মিসৌরির ছোট্ট শহর স্কিডমোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন কারণ তিনি কুকুরের জন্য ববি জো স্টিনেটের সাথে দেখা করবেন। কুকুরের ব্রিডার ছিলেন ববি জো স্টিনেট। কুকুর ছানা কিনবেন বলে স্টিনেটের ঘরে যান ও হঠাৎ দড়ি দিয়ে তাকে আক্রমণ করেন। তার মৃত্যু হওয়ার পর তার গর্ভাশয় কেটে আটমাসের বাচ্চা বের করে আনেন। স্টিনেটের নিথর দেহ উদ্ধারের পরের দিনেই তাকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মন্টেগোমারি।
এরপর মন্টগোমেরির অপরাধ, ব্যক্তিত্ব ও তার অভিজ্ঞতা তদন্ত করতে কয়েক বছর ব্যয় করেছিলেন মানবাধিকার আইনজীবী ও পেশাদার বিশেষজ্ঞরা। নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের চিকিৎসা করেন মনোবিজ্ঞানী ক্যাথরিন পোর্টারফিল্ড। তিনি বলেন,‘আমাদের বুঝতে হবে যে কোনও ব্যক্তির কাজে অন্য কোথাও গভীর সংযোগ থাকে। ট্রমায় থাকা মানুষি এমন কিছু করতে সক্ষম হয়ে যায় যা একজন সাধারণ কোন ব্যক্তি কল্পনাও করতে পারে না। আমি ২০১৬ সালে আপিল চলাকালে অনেকটা সময় কাটিয়েছি মন্টেগোমারির সাথে। মানসিক অসুস্থতা, শৈশবকালীন আঘাত বিয়য়গুলো অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।’
তিনি বলেন, মন্টেগোমেরির আইনজীবীরা বিচারের সময় তাকে তাকে সুরক্ষা দিতে পারেননি। আইনজীবী ডুচার্ড একটি অদ্ভুত আইনি যুক্তি নিয়ে এসেছিলেন যে লিসা সিডোসাইসিস নামক একটি বিরল মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তিনি স্টিনেটের বাচ্চাকে নিজের ভ্রুণ ভেবেই কেটে ফেলেছিলেন। আইনজীবীর ওই তত্ত্বটি সত্যের সাথে খাপ খায়নি এবং জুরি এটি স্বীকার করেননি। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা শারীরিক নির্যাতনের কয়েকটি প্রমাণ উদ্ধৃত করে কয়েকজনকে সাক্ষী করেছিলেন।
ক্লিনিকাল সমাজকর্মী জেনেট ভোগেলস্যাং ২১৬ সালে মন্টেগোমেরির সাথে বেশ কয়েকদিন কথা বলে সময় কাটিয়েছিলেন। বেশ কয়েক ঘণ্টা কথা বলে আস্তে আস্তে বন্দীর বিশ্বাস অর্জন করার পরেই লিসা তার শৈশবের ট্রমার কথা বলেছিলেন। জেনেট ভোগেলস্যাং বলেন, লিসার সাথে কথা বলা যুদ্ধের ফলে মানসিক আঘাত প্রাপ্ত সামরিক প্রবীণ আর ভিয়েতনাম এবং কোরিয়ার যুদ্ধের প্রবীণদের সাথে কথা বলার মতো ছিল।
গবেষণা শেষে ভোগেলস্যাং মন্টেগোমারির জীবন নিয়ে ১৮৪ পাতার একটি ‘সামাজিক ইতিহাস’ তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, ‘সেখানে লেখা বেশিরভাগ উপাদান কখনও জুরির কাছে উপস্থাপিতই হয়নি।’
জেনেট ভোগেলস্যাং বলেন, ‘লিসার শৈশবে যৌন হামলা এবং গণধর্ষণ, যৌন সহিংসতা অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে এটিকে বলা যায় শুরুরও শুরু। খুবই অল্প বয়স থেকেই মন্টগোমেরির মা তার কথা আটকে দিতেন। মেয়েকে উলঙ্গ করে তুলে মাতাল দর্শনার্থীদের সামনে বারান্দায় দাঁড় করাতেন। রক্তক্ষরণ না হওয়া পর্যন্ত পেটাতেন।’
ভোগেলস্যাংয়ের রিপোর্ট এমন উপসংহারে পৌঁছে যে মন্টগোমেরি ঘরে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছিল তা যুদ্ধবন্দীদের নির্যাতনের সমান ছিল। কারাগারে বর্তমানে লিসা নিবিড় মনোচিকিৎসায় রয়েছেন।