বিশ শতকের নারীবাদের প্রবক্তা সিমোন দ্য বোভোয়ার, জ্যাঁ পল স্যাঁত্রের সাথে আমরণ সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। সম্পর্কের বয়স ছিলো একান্ন বছর!! এ সম্পর্ক না ছিল ‘বৈবাহিক’, না ছিল ‘একত্র বাস’। বন্ধনহীন বন্ধনের গ্রন্থি ছিলেন তারা।
বিয়ে করে একসঙ্গে থাকা আর্থিকভাবে সুবিধাজনক মনে হলেও তাঁরা এ পথ বেছে নেননি, কারণ তাঁরা মনে করতেন বিয়ে বা একত্রবাস মানুষের জন্য ক্ষতিকর, যেহেতু এ ব্যবস্থায় একজন হয়ে উঠতে চায় ‘কর্তা’ আর অপরজনকে পরিণত করতে চায় ‘কর্মে’। তাঁরা উভয়েই বিশ্বাস করেছিলেন, যে সমাজ লিঙ্গের বৈষম্যেকে লালন পালন করে থাকে সে সমাজে আর যাই হোক বিয়ের মতো সামাজিক বন্ধন মানায় না। আবার একত্রবাসও পারষ্পরিক সম্পর্কগুলো অন্যের আধিপত্য থেকে মুক্ত রাখতে পারে না।
এখন এই লেখা পড়তে বসে কেউ যদি মনে করে থাকেন, আমি বৈবাহিক সম্পর্কের বিপক্ষে, তাহলেই হয়ে গেলো আর কি!
আমি বৈবাহিক, অবৈবাহিক কোন সম্পর্কেরই বিপক্ষে নই। তবে, যে কোন সম্পর্কই পারষ্পরিক আধিপত্য আর নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকাটা জরুরি বলে মনে করি আমি। যে কোন সম্পর্কই দুজন মানুষের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমেই পূর্ণতা দেওয়ার পক্ষে আমার অবস্থান। যে সম্পর্ক দুজনেই সমান ভাবে উপভোগ করতে পারে, পরষ্পরের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারে সে সম্পর্কের সৌন্দর্যে্য আমার পুর্ণ শ্রদ্ধা। সেজন্য দুজন সঙ্গীর সমান বোঝাপড়া জরুরি। এজন্য আপোস-সমঝোতা যাই করতে হোক না কেন, তা হওয়া উচিত ‘পারষ্পরিক’। আমি বিশ্বাস করি, দুজন মানুষ সম্পর্ককে সমানভাবে রেসপন্স করলে, সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারলে সে সম্পর্কে একজন আরেকজনকে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করার কোন সুযোগ থাকে না।
এখন প্রশ্ন হলো এই ‘সমান অংশগ্রহণ’। যদি দুজনই সুস্থ এবং স্বাভাবিক এবং শারিরীকভাবে সমান সক্ষম হয়ে থাকেন, তবে সম্পর্কে দুজনের অবস্থানও সমান হতে হবে। এটিই ন্যায্য।
যদি সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ কোনভাবে একজনের হাতে চলে যায়, একজন ‘কর্তা’ হয়ে অন্যজনকে বানিয়ে ফেলে ‘কর্ম’, যদি একজনকে সারাক্ষণ অন্যজনের মেজাজের ‘মিটার’মেপে কথা বলতে হয়, ‘উনার’ সময় সুযোগ মতো ‘জমি চাষ’ করতে দিতে হয়, যদি কর্তার সুযোগ, সুবিধা, ইচ্ছা ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে যেতে হয় সবসময়, তাহলে সেই সম্পর্ক ধরে রাখার ‘যোগ্যতা’ অর্জন না করাই সক্ষম এবং সামর্থ্যবান নারীদের জন্য মঙ্গলজনক।
আমার কাছে সমান মানে সমান। সে এক কোমর নামলে প্রয়োজনে এক গলা নামতে প্রস্তুত আমি। কিন্তু সম্পর্কে শান্তি রক্ষার নামে তাকে ডাঙ্গায় বসে থেকে আমাকে হাত পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে আমার সাঁতারের দক্ষতা বিচার করতে দিতে আমি রাজি না। আমি বরং বলি, কোন ধরনের আবেগেই সঙ্গীকে আপনার উপর অন্যায় করার সুযোগ দিয়ে যাবেন না। যখনই অন্যায় দেখবেন, প্রতিরোধ করুন। অন্যায়, অন্যায্য আচরণ, ডমিনেশন, এসব আয়তনে ওজনে যতই ছোট হোকনা কেন তা এখনই থামান। চোখে চোখ রেখে কথা বলুন। আপনি যে বিষয়টা পছন্দ করছেন না তা পরিষ্কার করে উচ্চারণ করুন। অবশ্যই অন্যজনকেও তার কথা বলতে দিন। কনক্লুশনে যাবার আগে বারবার কথা বলুন।
এতে হয়তো অ্যাপারেন্টলি কিছুটা বিরোধ তৈরি হবে, আপাতত সম্পর্কের শান্তি নষ্ট হবে। তবু বিরোধ হতে দিন, তর্ক হোক। আস্থা রাখুন দ্বিমতে।
মনে রাখবেন, চেপে চেপে নিম্নচাপকে শক্তিশালী করতে থাকলে একদিন সুনামি হবেই। তখন আপনি চোখ বন্ধ করে রাখলেও প্রলয় ঠেকানো যাবেনা। তাই গলা উঁচা করে হোক বা নিচু করে, কথা আপনাকে বলতেই হবে।
এবং এইসব কথা বলা-বিরোধ-উচ্চারণ-মিমাংসার পর যদি সম্পর্ক সমান অবস্থানে এসে দাঁড়াতে পারে তবে তাতেই স্বার্থকতা। আর যদি, সমান অবস্থানে আসতে না-ই পারেন, তবে কষ্ট হলেও একলা চলুন। মনে রাখবেন, একলা জীবন মানেই ‘অসুখী’ জীবন নয়। বরং অনেক সময় একলা জীবন অনেক বেশি সম্মানের, ব্যক্তিত্বের এবং মর্যাদার।
একলা চলতে সাহস লাগে, তেজ লাগে, দম লাগে। সেই তেজ সবার থাকেনা, সেই দম খুব কম মেয়েদের থাকে। যাদের থাকে না তাদেরই সম্পর্ক টেকানোর ‘যোগ্যতা’ লাগে। সম্পর্ক ধরে রাখার যোগ্যতা নয় অর্জন করুন সমতার সম্মান
সাদিয়া নাসরীন: সংযোগ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী। লেখক ও অ্যকটিভিস্ট