অভাগার গরু মরে আর ভাগ্যবানের কী? ভাগ্যবানের মরে বউ। কারণ গরু কিনতে অনেকটা সর্বস্বান্ত হতে হয়। আর বউ গেলে তো বউ আসে! এসব প্রবাদ একসময় নাকী খুব চলতো। এখনের বাঙালী পুরুষরাও কথাটি বেশ ব্যঙ্গ করে ব্যবহার করেন।
ভোর পাঁচটায় বাজলো বড় আপার ফোন।
রিসিভ করতেই কান্নাজড়িত কন্ঠে হড়বড় করে যা বললো তা হলো- আমাদের বাড়ির এক ছোট ভাইয়ের বউ মারা গেছে। বউটি মাত্র সপ্তাহখানেক আগে একটি মিষ্টি কন্যাসসন্তানের জন্ম দিয়েছে। আহ! বেচারি সপ্তাহান্তে দুনিয়া থেকেই চলে গেল।
আপার ফোন রেখে পাশে শুয়ে থাকা আমার বরকে ডেকে বললাম
এই শুনছো ?
বর: ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো কি হয়েছে ?
আমি: আলমের বউ মারা গেছে।
বর: কোন আলম ?
আমি: আরে আমাদের বাড়ির আলম। আমার চাচাতো ভাই হয় যে?
বরঃ ওহ আচ্ছা। ইশ কি সৌভাগ্য। পুরাতনটা গেছে এখন নতুন আরেকটা পাবে।
শীতের ভোরে মনটা কেমন করে উঠল। নারীর সম্পর্কগুলো এমনই ঠুনকো যে তার না থাকাটা আনন্দের পুরুষের জন্য?
আরামের ঘুম গেল। পেলাম মৃত্যু সংবাদ শুনলাম। এর উপর বরের মন্তব্য। আরে ধুর আমি এসব বেশি ভাবছি। সব রাগ গিয়ে পড়লো বড় আপার উপর। সকালটা গড়ালেও তো খবরটা দেওয়া যেত নাকী?
সারাদিন মাথায় ওই কথাটুকু ঘুরল। অফিসের কাজেও মনোযোগ দিতে পারলাম না। বারবার মনে হলো আমরা মেয়েরা কতো যে সংসার যে মানুষকে নিজের ভাবি তারা কী আসলে আমাদের কেউ হয়। কিছু আছে কী ওই বৈবাহিক জীবনে।
ভেবে মন ভরে না। অফিসে যে কজন ছেলে কলিগ আছে তাদেরকে কায়দা করে জিজ্ঞেস করলাম বউ মরে গেলে পুরুষরা খুশি হয় কী না?
তারা কেউ বললেন কষ্টের। কেউ হাসলেন। কেউ কিছু বললেন না৷ কেউ খুব আবেগভরা বক্তব্য দিলেন।
বাসায় গিয়ে ঝাড়লাম স্বামীকেও। ঝগড়া কান্না স্বান্তনার পর একসময় আমি থামলাম।
গল্পটা যদি এটুকুই হত তাহলেই ভাল হত৷ কথাগুলো আবেগগুলো ব্যক্তিগতই রয়ে যেত। কিন্ত তা হলো না।
যাক হোক এর মাঝেই অনেকগুলো মাস কেটে গেল। ডিসেম্বর এ অফিস থেকে ছুটি পেলাম আর ছেলের স্কুলও বন্ধ তাই বাবার বাড়ি গেলাম।
গিয়েই আলমের বাড়ি যাই। গিয়ে দেখি আলমের ঘরে নতুন ও সুন্দরী বউ। আর তার মা মরা মেয়েটাও বেশ একটু বড় হয়েছে। পরীর মতো মেয়ে। ওর আগের বউটাকে আমি দেখেছি মাত্র একবার। কিছুক্ষণের জন্য মনে পড়ল তাকে।
ওর গায়ের বরণ শ্যমলা ছিল। মানে কালো আর কী! মাঝারি গড়নের মিষ্টি ওই মেয়েটিকে তার স্বভাবজাত কারণেই খুব মিষ্টি লাগতো।
লাজুক লাজুক মুখে যখন দেখেছিলাম তাকে অন্তঃসত্ত্বা ছিল জান্নাত। আপা জেনে শোয়া থেকে উঠে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে এলো। আমি তাড়াতাড়ি সরে এসে
ওর হাত ধরলাম।
নাম জানতে চাইলাম।
নাম বললো জান্নাত।
দুই মিনিটের কথোপকথনের পর কী অদ্ভূতভাবে জড়িয়ে ধরলো। বললো আপা আবার আসিয়েন।
জান্নাত নেই এখন। আমার ওইটুক স্মৃতি ছিল তাকে নিয়ে।
আলমের নতুন সুন্দরী বউ দেখে বারবার আমার জান্নাতের কথা মনে পড়ছে। বাচ্চা মেয়েটাকে দেখেও কষ্ট হচ্ছে। জান্নাত কেন মরে গেল?
বাইরের ঘরে দেখা হল আলমের সাথে।
আমি: কি রে কেমন আছিস?
আলম: বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে হাসিমুখে বললো আলহামদুলিল্লাহ্ আপা অনেক ভালো আছি। ওর মেয়ের নাম ধরে বললো বাবুর নতুন মা কে দেখেছেন ?
আমি ওর এই উচ্ছ্বসিত চেহারা আর ঝকমকে চোখের চাহনিতে কিছুটা মর্মাহত।
অনেকক্ষণ তাকালাম
আস্তে আস্তে বললাম: হু। দেখেছি,
তোর নতুন বউ খুব সুন্দর (বাস্তবিক ই সুন্দরী)।
আলম একগাল হেসে বললো: আপা এবার আর আব্বার উপর ভরসা করিনি। আমি নিজেই ভালভাবে দেখে নিয়েছি বিয়ের আগে।
এতোদিনের নিজের মনে পুষে রাখা প্রশ্নটা ওকে করলাম।
আচ্ছা আলম তোর জান্নাতের কথা মনে পড়েনা ?
আলম নির্লিপ্ত গলায় আর খুব বিরক্ত হয়ে বললোঃ না আপা,ধুর !
আবার প্রশ্ন করলাম: ওর জন্য তোর খারাপ লাগেনি যখন মারা গেল?
এবার আল্ম একরাশ বিরক্তি আর তাচ্ছিল্য করে বলল: জান্নাতের মাঝে ছিলোটা কি? যে ওর জন্য খারাপ লাগবে…..?
রাগে ক্ষোভে আর ঘেন্নায় আমার বমি পেয়ে গেলো। ওখান থেকে চলে এলাম।
আমার জীবনে আজ অব্দি শোনা সবচেয়ে খারাপ কথাটি যেন শুনলাম।
যতদুর জানি জান্নাতের বিয়েতে ওর বাবা মোটা অংকের টাকা আর গয়না দিয়েছিলো শুধু মেয়ে কালো বলে!
বাচ্চা পেটে আসার পর ও তেমন আদর যত্ন পায়নি মেয়েটা। বাচ্চার জন্মের ৬দিনে নিউমোনিয়া হল। জান্নাত মারা যায় অনেকটা বিনা চিকিৎসায়। আলমের সংসারে ওর বসতি ছিল মাত্র ১৪ মাসের।
এতোদিন জান্নাতের মৃত্যু আমাকে কষ্ট দিত। আজ আমিও খুশি। মেয়েটার মুক্তি হল।
বেচে থাকতে আলমের কাছে কেমন ছিল জান্নাত? ভাল ছিল কী? ওকে কী অসুন্দর বলে অপমান করা হত?
ঘটনা আরো দশ বছর আগের। কিন্ত এই দশ বছরে আমি একদিন এর জন্য ও জান্নাতকে ভুলিনি।
এখন বুঝি কেন অভাগার গরু মরে?
আহা, যদি মেয়েরাও সবাই বুঝত। যদি জান্নাত বুঝত? গরুর চেয়ে কম মূল্যায়নের সম্পর্কে কী যেত?