নারীবাদী নারীর অসাধারণ হওয়ার দায়: ফারজানা সুরভী
সম্প্রতি এক নারীবাদী নারী সাংবাদিক নিজের একান্ত সম্পর্কে অ্যাবিউজ হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। ওই স্ট্যাটাসের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় নানা মন্তব্য এলেও সাধারণভাবেই একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে যে নারীবাদী নারী কেন তার অ্যাবিউজ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসেননি। অর্থাৎ একজন নারীবাদী নারীর অসাধারণত্ব থাকতে হবে। নারীবাদী কখনও ভিকটিম হতে পারে না।
ভিকটিমহুড ও অ্যাবিউজিভ সম্পর্ককে চিহ্নিত করা ও না থাকার সিদ্ধান্তে যাওয়া পর্যন্ত ভিকটিমের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে বিশ্লেষণ করে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক ফারজানা সুরভী নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি লেখা প্রকাশ করেছেন। ওই লেখায় তিনি দেখিয়েছেন ‘অ্যাবিউসিভ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা’ সাদাকালো বিশ্লেষণের একটি তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নয় বরং এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। তিনি বলেছেন—‘অ্যাবিউসিভ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা’, রাতারাতি নেওয়ার মত সিদ্ধান্ত নয়।’
অসাধারণত্ব চাওয়া, নারীবাদী একজন নারী কেন অ্যাবিউজ সহ্য করেছে?
‘ভালোবাসার বিভ্রমে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঘৃণার ঘরে ঢুকে পড়ি। আবার ঘৃণাতে মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে, পুরানো ভালোবাসার ছায়া দেখে থমকে যাই। পুণ্যবান হওয়ার শপথ করে, একদিন আমরা গন্ধম ফল খেয়ে ফেলি। অনুতাপে পুড়ে গন্ধম উগরে ফেলে দেই। তবু সে পাপের তিতকুটে স্বাদ বার বার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পুণ্যবান হওয়া একটি মিথ মাত্র!’
ফারজানা সুরভী লিখেছেন, ‘সম্প্রতি ফেসবুকে আমার বন্ধুরা অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন এই বলে যে- ‘নারীবাদী একজন নারী কেন অ্যাবিউজ সহ্য করেছে? তার কাছ থেকে তো অসাধারণত্ব প্রত্যাশা করি আমরা’! ‘সাধারণ’ এবং ‘অসাধারণ’ নারী, মানুষের মনস্তত্ত্ব কি এরকম সাদা-কালো কোন ব্যাপার? আমাদের আচরণ, চিন্তা, কাজ-সব কিছুর মধ্যেই ধূসর সব এলাকা থাকে। ভালোবাসার বিভ্রমে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঘৃণার ঘরে ঢুকে পড়ি। আবার ঘৃণাতে মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে, পুরানো ভালোবাসার ছায়া দেখে থমকে যাই। পুণ্যবান হওয়ার শপথ করে, একদিন আমরা গন্ধম ফল খেয়ে ফেলি। অনুতাপে পুড়ে গন্ধম উগরে ফেলে দেই। তবু সে পাপের তিতকুটে স্বাদ বার বার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পুণ্যবান হওয়া একটি মিথ মাত্র!’
তিনি লিখেছেন, নারীবাদের আদর্শ একজন মানুষ বিশ্বাস করতে পারে। জীবনে চর্চা করার প্রচেষ্টাও করতে পারে। কিন্তু পিতৃতন্ত্র থেকে মুক্ত হওয়া একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। একজন সচেতন এবং শক্ত মেরুদণ্ডের নারীও এবিউসিভ সম্পর্কের মারপ্যাঁচে আটকে যায়। কখনো কখনো এটা বুঝতেই তার সময় লাগে যে, সে একটি অ্যাবিউসিভ সম্পর্কে আছে। কখনো আবার এটা বুঝলেও, সে সঙ্গীকে শুধরানোর সুযোগ দেয়। কেননা আশা এবং ভালোবাসা এক ভীষণ গোলমেলে ব্যাপার! কোন সরলরৈখিক অনুভূতি নয়! শেষ পর্যন্ত কোন নারী যখন তাই অ্যাবিউসিভ সম্পর্ককে শনাক্ত করে এবং মুক্ত হয়ে আসে, তখন শুধু আমি তাকে অভিনন্দন জানাই। কারণ চক্র থেকে সে বের হয়ে এসেছে। পিতৃতন্ত্র থেকে মুক্ত হওয়ার নিরন্তর প্রক্রিয়াতে সে আছে। ভিক্টিম থেকে সারভাইভার হয়েছে।
সহিংসতা যখন দ্বিপাক্ষিক
ফারজানা সুরভী লিখেন, ‘অনেক সময় অ্যাবিউজ এবং সহিংসতা দ্বিপাক্ষিক হয়। সরল ভাষাতে বলতে গেলে, “ও আমাকে চড় মেরেছিল। আমি ওকে খামচি দিয়েছি”। সেক্ষেত্রে এই বিষাক্ত সম্পর্ককেই প্রেমিক-প্রেমিকা স্বাভাবিক ধরে নেয়।’
ভিকটিম যেভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হয়
আমেরিকার একটি ‘ভিক্টিম সেন্টার’-এ আমি ইন্টার্নশিপ করেছিলাম। সে সুবাদে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স সংক্রান্ত কিছু প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। সেরকম এক প্রশিক্ষণের ট্রেনিং ম্যানুয়ালের একটি প্যারাগ্রাফের বাংলা করছি নিচের অংশে।
“যাদেরকে কখনো অ্যাবিউজের শিকার হতে হয়নি, তারা সবসময় এটি চিন্তা করে বিস্মিত হয় যে- একজন নারী কেন এই ধরনের সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারে না! তারা সেই নারীকে প্রশ্ন করে- তুমি কেন বছরের পরে বছর ধরে এই এবিউজ সহ্য করলে?
এক্ষেত্রে আমাদের সবার জানা উচিত যে, একটি সম্পর্ক কখনো প্রথম দিন থেকে অ্যাবিউসিভ থাকে না। সম্পর্কের প্রথম অধ্যায়ে থাকে ভালোবাসা আর ঘনিষ্ঠতার চমৎকার সব সময়। তাই ভিক্টিম সম্পর্ক থেকে বের হতে চাইলেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়।
‘তারা সেই নারীকে প্রশ্ন করে- তুমি কেন বছরের পরে বছর ধরে এই এবিউজ সহ্য করলে?’
একটি অ্যাবিউসিভ সম্পর্কে কিন্তু সবসময় সহিংসতা দেখা যায় না। কখনো কখনো এমন সব সুন্দর মুহূর্ত আসে যে, নারীটির মনে হয়- হ্যাঁ, ঠিক এই কারণেই আমার সঙ্গীকে আমি ভালোবেসেছিলাম। একজন এবিউজার তার সঙ্গীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যে জাল বুনে- সেখানে ঘনিষ্ঠতা, রোমান্স, সহিংসতা এবং অ্যাবিউজ সবকিছু একইসাথে থাকে।
তাই যে নারী নির্যাতিত হয়, সে প্রায়ই সংশয়গ্রস্ত হয়। ভিক্টিম নারী ভাবে- আমরা তো ভালোই আছি। শুধু মাঝে মাঝে আমার সঙ্গীর আচমকা কী যেন হয়! সে আমাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে কিংবা সহিংস হয়! তবে কি আমারই কোথাও ভুল হচ্ছে?
এক্ষেত্রে জানা উচিত যে, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স অবশ্যই কোন র্যান্ডম ব্যাপার নয়। এটি একটি কমপ্লেক্স প্যাটার্ন । অ্যাবিউজাররা বিভিন্ন ধরনের কৌশল ব্যবহার করে। এবিউজার শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অন্যান্য এবিউসিভ আচরণের মাধ্যমে ভিক্টিমকে নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণত এবিউজের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি হতে থাকে।”
পুরুষও হতে পারে ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার
ফারজানা সুরভী লিখেছেন, ‘যদিও এই লেখাটিতে আমি বারবার “নারী” বিশেষ্য ব্যবহার করছি, মনে রাখা উচিত যে- অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষও ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের ভিক্টিম হয়ে থাকে। সম্পর্ক টেকানোর জন্য নারী কিংবা পুরুষ যে কেউই অনেক মরিয়া আচরণ করতে পারে। কারণ আমরা সবাই ভীত! আমাদের আছে একলা থাকার ভয়, সমাজের চোখ রাঙ্গানির ভয়, আর কারো হাতে হাত না রাখতে পারার ভয়। এইসব ভয় থেকে মুক্ত হতে পারলেই হয়তো তখন মানুষ এবিউসিভ সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসে। এই বের হয়ে আসাটাই দিন শেষে জরুরি!
ভিকটিম থেকে সারভাইভার হতে
ফারজানা সুরভী লিখেন, ‘সবশেষে আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই যে- একজন মানুষ হিসেবে অন্য একজন নিপীড়নের শিকার মানুষের প্রতি আমাদের এমপ্যাথেটিক আচরণ করা উচিত। ভিক্টিম থেকে সারভাইভর হওয়াটি একটি প্রক্রিয়া। সব ভিক্টিম শুরুতেই প্রতিবাদ করতে পারে না। সময় লাগে। ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাওয়া একজন মানুষের উঠে দাঁড়াতে সময় লাগে। তাই চট করে কাউকে জাজ করাটা খুব অসংবেদনশীল আচরণ মনে হয় আমার। যে ভিক্টিমের জীবন আমার যাপন করতে হয়নি, যার জুতাতে পা গলিয়ে আমার হাঁটতে হয়নি, তাকে অতোটা সহজে আমি জাজ করি না!’
উল্লেখ্য, ফারজানা সুরভীর পুরো নাম ফারজানা শারমীন সুরভি। জন্মস্থান ঢাকা, বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিক পলিসিতে স্নাতকোত্তরশেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্দান ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন। পেশায় একই বিভাগের টিচিং অ্যসিস্টেন্ট। নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি লিখেন, ‘লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখার ধৃষ্টতা নেই, কিন্তু লেখালেখির নেশায় একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখি।’