ঘরোয়া নির্যাতনের খবর জানিয়ে সাহায্য চেয়ে ফোনকল বাড়ছে ৯৯৯-এ। অনেকেই ফোন করে জানিয়েছেন তারা ঘর থেকে বেরিয় যেতে চান। কিন্তু গণপরিবহন না থাকায় সেটি পারছেন না। রলকডাউনে নারীর উপর ঘরোয়া নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন—বাড়িতে গৃহবন্দি অবস্থায় নারীরা আছেন সবচেয়ে বেশি নাজুক পরিস্থিতিতে। ছোটখাট কথা কাটাকাটি থেকেও বড় নৃশংসতা হচ্ছে। গৃহবন্দি মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষ অস্থির হয়েও পারিবারিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটাচ্ছেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও শালিস কেন্দ্র, ব্র্যাকের মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ এবং জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশে বর্তমান লকডাউন পরিস্থিতিতে পারিবারিক সহিংসতার পুরো চিত্রটা কেমন, সেটা নিয়ে এখনও কোন জরিপ প্রকাশ করা হয়নি।
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০ এর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৯৯৯-এ পারিবারিক সহিংসতা বিষয়ে ২ হাজার ৪৩৮টি, নারী নির্যাতনের ১ হাজার ৬৩৫টি, বাল্য বিয়ে বিষয়ে ১ হাজার ৫৮৪টি, যৌন নির্যাতনের ৩৬২টি এবং শিশু নির্যাতনের ব্যাপারে ৫৭টি কল আসে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নারী ও মেয়ে শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রোগ্রামের সমন্বয়ক অর্পিতা দাস জানান, আগে যারা নির্যাতনের শিকার হতেন তারা এখন আরও বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন। যারা নির্যাতিত হতেন না তারাও এসময় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেকের অভিযোগ ৯৯৯-এ ফোন করে কাজ হয়নি।
ঘরোয়া নির্যাতনের বিষয়ে এক আইনজীবী বলেন, পারিবারিক নির্যাতনের মামলায় বেশিরভাগ লক্ষ্য করা যায় পুরুষরাই নারীদের শারীরিকভাবে নিগ্রহ করেন। লকডাউনে অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় পারিবারিক বিবাদ বেশি দেখা যাচ্ছে। নারীর ক্ষেত্রে সেটি শারীরিক আক্রমণে রূপ নিতে খুব বেশি সময় লাগে না। এর ফলে পারিবারিকভাবেই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অনেক নারী। কারও কারও ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে তাদের বৈবাহিক কলহ থাকলেও চলতি লকডাউন পরিস্থিতিতে এটি মাত্রা বেড়েছে। এছাড়াও কেবল নারীরা নন কিছু পুরুষরাও এমন সময়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে তারা ব্যবস্থা নিতে চাননি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী জানান, গত কয়েকদিনে তাদের হেল্পলাইনে ঘরোয়া সহিংসতা সম্পর্কিত ফোন কলের সংখ্যা বেড়েছে। জাতীয় জরুরি হেল্পলাইনেও সহিংসতার বিরুদ্ধে সাহায্য চেয়েছেন অনেকে। অনেক নারী ফোন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা সেটা পারছেন না। নির্যাতিত নারীদের আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা থাকলেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কে নতুন করে কাউকে সেখানে যুক্ত করা হচ্ছে না।
নীনা গোস্বামী বলেন, ‘বাস্তবিক যে চিত্র আমরা দেখতে পারছি সেটা বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে পারিবারিক সহিংসতার হার অন্যসময়ের চাইতে এখন অনেক বেশি।’
এদিকে বৈশ্বিক অবস্থাও প্রায় একই। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএফপিএ এবং এভেনার হেলথ, জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, ও অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশে গত তিন মাসের লকডাউনে পারিবারিক সহিংসতা ২০ শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছর বিশ্বে অন্তত দেড় কোটি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে ইউএনএফপিএ-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়।
উল্লেখ্য, শুধু এপ্রিল মাসেই দেশে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪ হাজার ২৪৯ জন নারী। তাদের মধ্যে ৮৪৮ জন শারীরিক নির্যাতন, প্রায় ২ হাজার নারী মানসিক নির্যাতন ও ১৩০৮ জন অর্থনৈতিক নির্যাতনের (খাদ্য ও অর্থাভাব) শিকার হয়েছেন। এছাড়াও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৮৫ জন। এ সময়ে ৩৩টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এপ্রিল মাসে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ৪২টি। এর বাইরে, অন্তত ৪২৪ শিশু তাদের পরিবারে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। —মাঠ পর্যায়ের ২৪টি সহযোগী সংস্থা ২৭ জেলার তথ্য নিয়ে জরিপটি পরিচালনা করেন। এসময় মোট ১৭ হাজার ২০৩ জন নারীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে নির্ধারিত প্রশ্নের ভিত্তিতে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে হটলাইন ১০৯ ও পুলিশি সহায়তার জন্য ৯৯৯ আরও বেশি কার্যকর করার অনুরোধ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নারীরা যাতে আশ্রয় পেতে পারেন সেই ব্যবস্থা নিতেও জোর দেন তারা।
ডব্লিউভিবি